ঐতিহাসিক ই এইচ কার বারবার বলেছিলেন যে বর্তমান আর অতীতের মধ্যে কথোপকথন হল ইতিহাস। এই কথাবার্তা এক নিরন্তর প্রক্রিয়া। পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে দীপ্তেন্দ্র সান্যাল অচলপত্রে লিখেছিলেন, এটি আজ West Bengal নয়, Waste Bengal হয়ে গিয়েছে। আজ ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে আবার সেই একই কথা আলোচিত হচ্ছে। ইতিহাস ঘুরে ঘুরে আসে? ইতিহাস চক্রবৎ না সর্পিল, এ সব বিতর্কও থাক। সমস্যা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি দেখে চিত্তে হর্ষ উৎপন্ন হওয়ার কোনও কারণ দেখছি না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিদায় সুনিশ্চিত, এ কথা যারা ভাবছেন তারাও কি বৈজ্ঞানিক পথে হাঁটছেন?
প্রথমত, দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে রাজ্যে মূল লড়াইটি ছিল সিপিএম বনাম অ-সিপিএম প্রতিপক্ষ দলগুলির। এর ফলে বিজেপি, কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোট ভাগাভাগির লাভ সর্বদাই পেয়েছে সিপিএম। আর সেই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএম বিরোধী মহাজোট গঠনের চেষ্টায় ব্রতী হন। মমতা চেয়েছিলেন সিপিএমকে রাজ্যছাড়া করতে এটাই হবে তাঁর একমাত্র অগ্রাধিকার। সে কাজে সাহায্য করতে যাঁরা আসবেন তাঁদেরকেই স্বাগত জানানো হবে। এই কারণে, এসইউসিআই থেকে নকশাল, সকলেই সে দিন ছিল স্বাগত। এমনকী, ফব, আরএসপি এমনকী সিপিআইয়ের মতো দলগুলিকেও মমতা কাছে টানতে চেয়ছিলেন।
আজ পরিস্থিতি পরিবর্তিত। রাজ্যে তিন বছর শাসনকার্যের পর মমতা বিরোধিতাই হয়ে উঠেছে রাজনীতির প্রধান উপজীব্য। তাই এ বার লড়াই মমতা বনাম অ-মমতা প্রতিপক্ষের। এ ক্ষেত্রে বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস— সবাই যদি জোট বাঁধে তবেই ভোটে মমতার লোকসান। কিন্তু ’৮৯ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহকে সামনে রেখে যে ভাবে জোট বেঁধেছিল কমিউনিস্ট এবং বিজেপি, তা কি এ বার ২০১৬ সালে সম্ভব? বিজেপি এবং সিপিএমের মতো দুই প্রতিযোগী দলের মধ্যে কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বোঝাপড়ার সম্ভাবনা দেখছি না। বরং সিপিএমের ভোট শতাংশ ক্রমেই কমছে। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতি ও নৈরাজ্য সিপিএম জমানায় কম হয়নি। দলতন্ত্র কী ভাবে সে সময় শিক্ষাক্ষেত্রকে গ্রাস করেছিল তা কি মানুষ আজ বিস্মৃত? সিপিএমের আন্দোলনমুখিনতা নিশ্চয়ই আগের চেয়ে বাড়ছে, কিন্তু মমতার বিকল্প হিসাবে সিপিএমকে মানুষ এখনও ভাবতে পারছে?
বিজেপির প্রত্যাশা বেড়েছে। কারণ, বিজেপির শতকরা ভোট রাজ্যে অনেক বেড়েছে। আগে শতকরা ভোট ছিল ৯ শতাংশ। লোকসভা নির্বাচনে তা বেড়ে হয়েছে ১৬ শতাংশ। কিন্তু মনে রাখতে হবে রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট শতকরা ৩০ ভাগ। বিজেপির কোনও শরিক দল নেই। তাই একক ভাবে ক্ষমতা দখল করতে গেলে বিজেপির চাই শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ ভোট। যা আজ কার্যত অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। বিজেপির শীর্ষ নেতারা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, শতকরা ভোট বৃদ্ধি রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। মমতা সরকারের প্রতি যদি মানুষের ক্ষোভ বাড়ে তখন বিজেপিরও ভোট বাড়বে। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মোদী ঝড় থাকবে বলে বিজেপি নেতারাও মনে করেন না। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্ত মানুষের মনে যদি প্রভাব ফেলে তবে বিজেপি অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটাতে পারে।
যদি তৃণমূল কংগ্রেস ভেঙে যায়, যদি অন্য কোনও ‘আউট অফ দ্য বক্স’ ব্যক্তিত্ব মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থী হন, নতুন দল করেন, যদি তাঁকে বিজেপি থেকে সিপিএম সকলেই সমর্থন করে তবে সে ক্ষেত্রে রাজনীতির পরিণতি কী হবে সেটাই দেখার।
বিরোধী দল থেকে শাসক দল হওয়া এবং জনপ্রিয়তা অপসৃয়মান হলে শাসক ফের হয়ে যায় বিরোধী নেতা। এ তো ল’ অফ নেচার, প্রকৃতির এই সূত্রকে ইন্দিরা গাঁধী থেকে বাজপেয়ী কেউ আটকাতে পারেননি। তা হলে মমতাই বা ব্যতিক্রম হবেন কী করে? মমতা সফল নেত্রী। তিনি সিপিএমের অপসারণে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তিনিই চিরকাল ক্ষমতাসীন থাকবেন সেটাও বাস্তবসম্মত ইতিহাসবত্তা নয়।
সমস্যা হচ্ছে, এখনই মমতার কোনও বিকল্প চোখে পড়ছে না। ভোট বিভাজনে আপাতত ফয়দা মমতারই। বিরোধী দলের প্রতিযোগিতায় বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, এবারের দু’টি উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ও বিজেপির ভোট কমেছে।
বাঙালি সম্পর্কে বলা হয়, বাঙালি খারাপ উপভোক্তা বা কনজিউমার। এক বার পুজোর সময় বাটা থেকে জুতো কিনলে সেটাই ন্যূনতম দশ বছর পরতে চায়। তাই বাংলায় রিপেয়ার শপ-ও বেশি। বাংলা আর্থিক উদারবাদের ঝোড়ো হাওয়ার পরেও এতটা স্লো-আয়ে সোসাইটি হতে পারেনি। তবে বাজার সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, বাংলার আধুনিক প্রজন্মও বদলাচ্ছে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও কি ফের পরিবর্তনকামী হয়ে উঠছেন তাঁরা? আর্থিক অবক্ষয় চরমে। রাজনীতির দলতন্ত্র ভয়াবহ। অনেকে বলছেন, এ হল extension of bad cpm-ism. কিন্তু বিকল্প না থাকলে তৈরি হবে রাজনৈতিক ‘ফল্ট লাইন’— আসবে নৈরাজ্য। মাওবাদীরা-নকশালরা এসেছে, নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে এ রাজ্যে নানা সময়ে। ইতিহাসের পটে সাম্প্রতিককে দেখে মনে হচ্ছে আবার কি এক নৈরাজ্য অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?