১১ নভেম্বর ছিল এ দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদের ১২৭তম জন্মদিন। এই দিনটি ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কথাটি যান্ত্রিক ভাবে পরিবেশন করলাম এই কারণে যে, আমরা অধিকাংশই এইটুকুও জানি না বা জানার তাগিদ অনুভব করি না। হ্যাঁ, রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতর কলকাতার টাউন হলে আজাদ স্মরণে সভার আয়োজন করেছিল। উদ্যোগ শুধু এইটুকুই। হলেও আধা-সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে আরও কিছু জায়গায় ‘শিক্ষা দিবস’ পালিত হয়েছে, যাকে রাজ্যের নিরিখে যত্সামান্যই বলা চলে। অথচ এই সুপণ্ডিত এবং উন্নতমনা মানুষটি কেবল এক জন স্বাধীনতা সংগ্রামী বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন না, ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মৈত্রীর অন্যতম অগ্রদূত। আজকের এই বিভেদদীর্ণ সময়ে মওলানা আজাদের আদর্শ আরও বেশি করে স্মরণীয় হওয়া উচিত ছিল।
পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে মওলানা আজাদের জন্মদিন পালন করছে। প্রতি বছর এই দিনে অনুষ্ঠান হয়, দেওয়া হয় মওলানা আজাদ পুরস্কার, বেগম রোকেয়া পুরস্কার, অনুষ্ঠিত হয় আজাদ স্মারক বক্তৃতা। প্রকাশিত হয় পুস্তকপুস্তিকা। সল্টলেকে নবনির্মিত মাদ্রাসা বোর্ডের ভবনটির নামকরণ হয়েছে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ভবন। ২০১১ থেকে মাদ্রাসা বোর্ড তার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলিকে ওই দিন ‘উদযাপন দিবস’ পালনের নির্দেশ দিয়েছে। এ বারও অনেক মাদ্রাসা সাড়ম্বরে ওই দিনটি উদযাপন করেছে। কেউ কেউ অতি উত্সাহে মাদ্রাসায় ছুটিও ঘোষণা করেছে।
সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। মধ্যশিক্ষা বোর্ড, উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিল, সিবিএসই বা আইসিএসই বোর্ড থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও শিক্ষা দিবস পালনের খবর নেই। নেই কোনও নির্দেশিকা। কোনও বছর কোথাও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ দেখা গেলেও তাকে ব্যতিক্রম বলাই শ্রেয়। এক কথায়, সাধারণ শিক্ষার অঙ্গনে আজাদের জন্মদিনে ‘শিক্ষা দিবস’ পালন ব্রাত্যই থেকে গেছে। এ বারের শিক্ষা দিবস উদযাপন প্রসঙ্গে কিছু সাধারণ স্কুলের প্রায় পঞ্চাশ জন প্রধান শিক্ষক বা সহ-শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম। মাননীয় শিক্ষকদের অধিকাংশ জানেনই না, মওলানা আজাদের জন্মদিনকে শ্রদ্ধা জানাতে এই শিক্ষা দিবস ঘোষিত হয়েছে।
এই উপেক্ষা রাজ্যের শিক্ষার বেহাল দশার কথাই স্মরণ করায়। উপেক্ষা মওলানা আজাদকেও। এবং, উপেক্ষা-উদাসীনতার পশ্চাতে সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতাবোধের অস্তিত্বকেই বা অস্বীকার করি কী ভাবে? যে সাম্প্রদায়িকতা গড়ে ওঠে আমাদের প্রতিদিনের আচরণে, আমাদের ব্যবহারিক বিশ্বাসে, মগজের গভীরে? তাই হয়তো মাদ্রাসা বোর্ড বা মাদ্রাসাগুলি গভীর আন্তরিকতায় মওলানা আজাদকে স্মরণ করে, আর মূলত অ-মুসলিম নিয়ন্ত্রিত সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলি জন্মলগ্নেও এমন এক জন মানুষকে ভুলে থাকে। এই লজ্জাজনক সত্যকে স্বীকার না করলে তা হবে ভাবের ঘরে চুরি।
লক্ষণীয়, রাজারহাটে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন হল গত ১১ নভেম্বর। গাড়ি ভাড়া, টিফিন খরচ দিয়ে আনা হল মাদ্রাসার পড়ুয়াদের। সন্দেহ হয়, এটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল। আলিয়া মোচ্ছব + আজাদ স্মরণ = মুসলিম ভোট। চমত্কার সমীকরণ! এই রাজনীতির তাগিদেই তো, দশ হাজার মাদ্রাসা রাজ্যে না থাকলেও, মুখ্যমন্ত্রী দশ হাজার মাদ্রাসাকে অনুমোদনের কথা ঘোষণা করে দেন। মুসলিমদের জন্য নজরুল অ্যাকাডেমি করে দিলাম বলে গর্ব করেন!
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এই প্রকাশ মওলানা আজাদ বা কবি নজরুলদের অপমান, অপমান মুসলিমদের বোধশক্তিকেও এই সত্য সবচেয়ে আগে উপলব্ধি করতে হবে মুসলিম সমাজকেই।
তালপুকুর আড়া হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক