গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক চূড়ান্ত আর্থিক মন্দার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ‘সুপারম্যান’। সে ছিল এক কমিক স্ট্রিপ। সুপারম্যান যখন প্রথম জনসমক্ষে হাজির হয়, তখন সে এক খলনায়ক। মানুষের অকল্যাণই তার কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু তার ক্ষমতা ছিল অসীম। কিছু দিনের মধ্যেই পরিবর্তন এল। সুপারম্যান দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করতে শুরু করলেন। না করে উপায় ছিল না। মহামন্দায় বিপন্ন মানুষ তখন পরিত্রাতা চেয়েছিল।
পরিত্রাতার স্বপ্ন মানুষ চিরকাল দেখেছে। এবং স্বপ্নের চেয়ে বড় স্রষ্টা আর কে-ই বা? সংকট না থাকলে, মানুষ সুদিনের আশায় উজ্জীবিত হলে, পরিত্রাতার দরকার হয় না। সদ্য-স্বাধীন ভারতের কথাই ধরুন। রাজ কপূর বেকার আওয়ারা হলেও তাঁকে রাগী যুবক হতে হয়নি। কারণ তখনও দেশের মানুষ হতাশ হননি। তখনও নেহরু-ফ্যানটাসি। তার পর ১৯৬২। বড় ধাক্কা দিল চিন। অচিরে নেহরুর বিদায়। ১৯৬৭’র নির্বাচনে রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস প্রথম ধরাশায়ী হল। তত দিনে কংগ্রেসের অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে। আমজনতা থেকে দলের নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। দলীয় সংগঠনে ভুয়ো সদস্যের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ক্রমে সত্তরের দশক। ‘এন্ড অব ইনোসেন্স’। বেকারি, দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি, হতাশা, চরমপন্থী চ্যালেঞ্জ। জন্ম নিল বলিউডের এক নয়া অবতার। রাগী যুবকের ভূমিকায় অমিতাভ বচ্চন। এ সবই ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, বলিউডের পর্দায় অতিবাস্তব। কিংবা হয়তো পরাবাস্তব। স্বপ্নপূরণের অভিজ্ঞান।
রাজনীতির ময়দানেও তেমন অভিজ্ঞান বার বার খুঁজেছে মানুষ। সত্তরের দশকে জয়প্রকাশ নারায়ণ অথবা ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ থেকে সম্প্রতি দিল্লিতে নাগরিক সমাজ অরবিন্দ কেজরীবাল— বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিমার জন্ম দিয়েছে ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজ। কোনও একটির সঙ্গে অন্যটি তুলনীয় নয়, কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মানুষ নিজের মতো করে মুশকিল আসান খুঁজেছে। সত্তরের দশকের গোড়ায় ইন্দিরা গাঁধীর ভারতমাতা রূপ মনে না পড়ে উপায় নেই। তার পরিণাম শুভ হয়নি। কিন্তু স্বপ্ন দুর্মর।
২০১৪ সালে সে কথা আবার মনে পড়ছে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল জানতে এখনও বেশ কয়েক সপ্তাহ বাকি। কিন্তু ভারতীয় শিল্পমহল এবং এই সমাজের এক বড় অংশ আজ মনমোহন সিংহ সরকার তথা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের উপর নানা কারণে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি এবং নীতিপঙ্গুতার মতো বিবিধ কারণে দেশ জুড়ে শাসক কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া তীব্র হয়ে উঠেছে। দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ইউপিএর বিরুদ্ধে এই অসন্তোষ হয়তো অনিবার্য, হয়তো বা প্রকৃতির সূত্র! কিন্তু কংগ্রেস-বিরোধিতায় সৃষ্ট এই রাজনৈতিক পরিসরটি দখল করতে সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড ইক্যুইটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। তিনিই যেন ভারতের সুপারম্যান। ভারতের নির্বাচকমণ্ডলী অনেক সময়েই নেতি নেতি করে কারও বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এ বারেও এই নেতিবাচক ভোটের প্রবণতা লক্ষণীয়। কিন্তু এই পরিসরটি যত না বিজেপির, তার চেয়েও বেশি নরেন্দ্র মোদীর জন্য।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। কংগ্রেস-বিরোধী ঝড় এ দেশে বার বারই দেখা গেছে। ১৯৬৭’র পর দশ বছরের মধ্যেই ১৯৭৭, আবার তার এক যুগের মধ্যে ১৯৮৯। এর পরেই কংগ্রেস-বিরোধী পরিসরটি দখল করে প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে বিজেপি। ছ’বছর (১৯৯৮ থেকে ২০০৪) ক্ষমতায় থাকার পর এ দেশে বিজেপি-বিরোধিতার ‘ল অব নেচার’ও দেখেছি, তাই বিজেপিকে শাসক দল হিসাবে আজ আর নবাগত তো বলা যাবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসাবে মোদী এক নতুন মুখ, নতুন পরিসর, ভারতবাসীর সামনে এক নতুন অবতার, নতুন ম্যাজিক।
গুজরাতের সাফল্য ‘মিথ’ না বাস্তবতা, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের বিতর্ক চলছে, কিন্তু সে বিতর্ককে পাশে সরিয়ে এ কথা বলা বোধহয় ভুল হবে না যে শুধু আর্থিক বৃদ্ধি, জিডিপি আর উন্নয়নের পরিসংখ্যান নয়, মোদীং (না কি, মোদিনং?) শরণং গচ্ছামি-র এক সামাজিক মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠেছে।
কেউ কেউ বলছেন, মোদী আসলে এক সফল ইভেন্ট ম্যানেজার, দেশ জুড়ে বাস্তবের রাজনীতিতেও এক ‘হাইপাররিয়ালিটি’ তৈরি করেছেন তিনি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটও যেন এক রিয়ালিটি শো। এই প্রদর্শনীর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উমবের্তো একোর কথাও টেনে আনা যায়। তিনি বলেছিলেন, গোটা পৃথিবীটাই যেন এক ‘হলোগ্রাম’ সমাজে পরিণত হয়েছে। লেসার রশ্মি দিয়ে প্রযুক্তির খেলা, আর রাজনীতি হল এখন ‘রিয়েল ফেক’।
এমন ব্যাখ্যার যুক্তি আছে। মোদীর ছবি ও নামাঙ্কিত পিচকারি এসেছিল দোলের বাজারে, উত্তরপ্রদেশে এসেছে মোদী শাড়ি। কতগুলি জীবনী প্রকাশিত হল ভোটের মুখে। কিন্তু সত্যিই কি সবটাই অবভাস, সত্য নয়? ম্যানুফ্যাকচারড জনমত? তর্কের খাতিরে এই সমালোচনা মেনে নিলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বহু মানুষই এখন এক নায়ক খুঁজছেন। একনায়ক ভাল কি না, সে প্রশ্ন নিয়েও তাঁরা অনেকেই ভাবতে রাজি নন। নরেন্দ্র মোদী নামক এক রক্তমাংসের ব্যক্তিকে অবতার বানিয়ে আপাতত উত্তরণের স্বপ্নবিলাসে তাঁরা মগ্ন। এই অবতারবাদকে মধ্যযুগীয় বা সামন্ততান্ত্রিক বিশ্বাস বলে গালি দিয়েও কোনও লাভ নেই। ‘আধুনিক’ ভারত এই নয়া মধ্যযুগীয়, নয়া সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতাকে বহন করছে, এটা সত্য। নির্মম সামাজিক সত্য।
অবতারবাদে এক জন ব্যক্তির মধ্যে সমস্ত প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা হয়। অনেকটা পুরনো দিনের রাজতন্ত্রের মতো। প্রজা রাজার হাতে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, যুগ বদলেছে। অবতারের চ্যালেঞ্জ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। ভারত আজ এক জোটযুগে অবতীর্ণ। নানা ভাষা, নানা মত, নানা ধর্ম, নানা আঞ্চলিক সত্তা ও প্রত্যাশার বহুত্ববাদী ভারতে একাধিপত্য আজ আর কোনও সমাধান এনে দিতে পারে না। তাই মোদী প্রধানমন্ত্রী যদি হন, তাঁকে চলতে হবে সকলকে নিয়ে। শক্তিশালী এক অখণ্ড ভারত রাষ্ট্র গঠনের পেশিবাহুল্যে এই বহুত্ববাদের উপর যাতে স্টিম রোলার চালানো না হয়, সেটা দেখাও কিন্তু নব্য অবতারের বড় দায়িত্ব।