প্রবাদোক্ত চতুর্থ জামাতাটি প্রহারের পূর্বে শ্বশুরালয় ছাড়ে নাই। ভারতীয় ক্রিকেটের বহু নামজাদা খেলোয়াড় সেই ধনঞ্জয়ের অনুসারী। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ব্যতিক্রমী হইলেন, সন্দেহ নাই। টেস্ট ক্রিকেট হইতে তাঁহার অবসরের সংবাদটি চাউর হওয়ার পর ‘এখনই কেন’ মর্মে হাহুতাশ শোনা গেল। সময় থাকিতে বিদায় লওয়ার কৌশলটি রপ্ত করিবার মধ্যে কৃতিত্ব আছে। তবে, সময়ের ভিন্নতর প্রশ্নে তাঁহার সিদ্ধান্তটি প্রশ্নযোগ্য। অস্ট্রেলিয়ায় ভারত একটি টেস্ট সিরিজ খেলিতেছে, এবং একটি টেস্ট অবশিষ্ট থাকিতেই সিরিজে পরাজিত হইয়াছে। ধোনি সেই পরাভূত দলের অধিনায়ক। অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য তাঁহার সিরিজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বিধেয় ছিল। মাঝপথে খেলা ছাড়িয়া দেওয়ার মধ্যে যে মনোবৃত্তির প্রকাশ, তাহাকে পলায়নী বলিলে অত্যুক্তি হয় না। বস্তুত, এই সিরিজের তো বটেই, ধোনির আরও অনেকগুলি দায় গ্রহণ করা উচিত ছিল। তাহার আমলে ভারত বিদেশের মাটিতে বারংবার নাজেহাল হইয়াছে। ভারতের সর্বাধিক টেস্টজয়ী অধিনায়ক যেমন তিনি, বিদেশের মাটিতে সর্বাধিক বার পরাজিত অধিনায়কও তিনিই। তাহা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু, এই ব্যর্থতাগুলির জবাবদিহি না করিয়াই টেস্টকে বিদায় জানানোও পলায়ন।
ধোনি টেস্ট ছাড়িয়াছেন, এক দিনের ক্রিকেট বা টি টোয়েন্টি নহে। অনুমান করা চলে, তিনিই সেই দলগুলির অধিনায়ক থাকিবেন। ক্রিকেটের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের খেলায় ভিন্ন ভিন্ন অধিনায়ক রাখিবার যৌক্তিকতা খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। যে খেলোয়াড় তিনটি গোত্রেই দড় এবং অধিনায়কত্বে সক্ষম, তাঁহাকেই দায়িত্ব দেওয়া বিধেয়। তবে, কেন ধোনি টেস্ট ছাড়িলেন কিন্তু অন্যগুলি নহে, সেই প্রশ্নের একটি কারণ অনুমান করা সম্ভব। ক্রিকেট-রক্ষণশীলদের মন ভাঙিয়া গেলেও স্বীকার করিয়া লওয়া ভাল যে টেস্ট ক্রিকেট মৃত। অন্য দুইটি ধরনই খেলাটির ভবিষ্যত্। তাহাতেই অর্থ, তাহাতেই যশ, তাহাতেই মান। সেই হিসাব কষিতে ধোনি সম্ভবত ভুল করেন নাই। আশঙ্কা, অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক ক্রিকেটার তাঁহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিবেন। তাহাতে অন্যায় নাই। খোলা বাজারের লড়াইয়ে যে খেলা টিকিতে পারিবে, সেই খেলাই থাকিবে। টেস্ট ক্রিকেট যদি গৌরবময় অতীত হইয়াই থাকিয়া যায়, ক্ষতি কী?
কেহ অনুমান করিতে পারেন, ধোনির অবসরের সিদ্ধান্তের পিছনে মুদগল কমিটি রিপোর্ট ইত্যাদির ভূমিকা আছে। আইপিএল-কেলেঙ্কারিতে ধোনি কতখানি জড়িত, সেই প্রশ্নের উত্তর কিছু দিনের মধ্যেই মিলিবে বলিয়া অনুমান। হয়তো কিন্তু, সেই উত্তরের অপেক্ষায় না থাকিয়াই বলিয়া দেওয়া যায়, ধোনির আচরণ আদর্শ নহে। তাঁহার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহা গুরুতর। ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি যে ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত, তাহাতে এই অভিযোগগুলি ভিন্নতর মাত্রা পায়। অভিযোগ উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়া দাঁড়ানো ধোনির কর্তব্য ছিল। হয় তিনি নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থগুলি ত্যাগ করিতে পারিতেন, নয় ক্রিকেট হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে পারিতেন। তিনি কোনওটিই করেন নাই। তাঁহার ‘থোড়াই কেয়ার’ ভঙ্গিমাও কোনও সদর্থক বার্তা দেয় নাই। তাঁহার খেলোয়াড়-জীবন কম বর্ণময় নহে। কিন্তু তাহাতে কলঙ্কের দাগকে এমন অনপনেয় না করিলেও ধোনির চলিত। তাহাতে অন্তত যাওয়ার বেলায় কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন এড়াইতে পারিতেন তিনি।