আত্মসমর্পণ

জ়াইরার বিবৃতিটি এ দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতার দিকে আর এক বার দিকনির্দেশ করিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share:

ছবি: রয়টার্স।

বিপন্ন হইয়াছে বিশ্বাস। বিপন্ন, ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক। তাই কাজের জগৎ হইতে বিদায় চাহিয়াছেন উদীয়মান অভিনেত্রী জ়াইরা ওয়াসিম। সোশ্যাল মিডিয়ায় দীর্ঘ বিবৃতিতে স্বেচ্ছাবসরের কারণ ব্যাখ্যা করিয়াছেন অষ্টাদশী। বিবৃতিটি পড়িলে সংশয় জন্মাইতে পারে, তিনি হয়তো মৌলবাদী ফতোয়ার নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন। সমালোচনার মুখে তো কম পড়িতে হয় নাই তাঁহাকে। পোশাক লইয়া, কাশ্মীরের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাওয়া লইয়া বারংবারই কট্টরপন্থীদের তিরবিদ্ধ হইয়াছেন তিনি। আর এখন স্পষ্টই ঘোষণা করিলেন, ধর্ম আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তাঁহার ব্যক্তিগত জীবন এবং কাজের মধ্যে। পেশাগত জগৎ হইতে ধর্মকে তিনি পৃথক করিতে পারেন নাই, উভয়ের টানাপড়েনের শেষে ধর্মীয় বিশ্বাসকেই অগ্রাধিকার দিতেছেন। জ়াইরার এই আত্মসমর্পণেই মৌলবাদের জিত— যেখানে পেশাগত জীবন তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনও ধর্মের অনুশাসন দ্বারা চালিত হয়। ধর্মই স্থির করিতে থাকে, কোন কাজটি উচিত, কোনটি নহে।

Advertisement

জ়াইরার বিবৃতিটি এ দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতার দিকে আর এক বার দিকনির্দেশ করিল। তিনি একটি উদাহরণমাত্র। ধর্মীয় চাপের মুখে নতিস্বীকার এখন আর এই দেশে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় না। প্রসঙ্গত, ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশোধনে ভারতকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছিল, কিন্তু সেই ঘোষণার পূর্বেও প্রত্যক্ষগ্রাহ্য জনপরিসরে ধর্মীয় আগ্রাসনের এমন উদগ্র প্রকাশ দেখা যায় নাই। ভারতের এক বৃহৎ অংশ মূলত নেহরু, মহাত্মা গাঁধীর সহাবস্থানের আদর্শে আস্থা রাখিয়া চলিতেছিল। ধর্মীয় উগ্রতার নিকট নতিস্বীকারের ঘটনা সেখানে নিশ্চয় ছিল, কিন্তু অনেকার্থেই তাহা ছিল প্রান্তিক, বিচ্ছিন্ন, সমালোচনার লক্ষ্য। বর্তমান ভারতে এই ধর্মসর্বস্বতা আর প্রান্তিক নাই— স্বাভাবিকতায় পরিণত। জ়াইরাই দেখাইয়া দিলেন, মৌলবাদের সামনে এমন আত্মসমর্পণ আজ আর ভারতীয় সমাজে কোনও বিশেষ সংবাদ নহে, স্বাভাবিক সংবাদ। ।

লক্ষণীয়, ইসলামি মৌলবাদের সঙ্কট লইয়া দীর্ঘ কাল ভারত ভুগিতেছে, তসলিমা নাসরিনের হেনস্থা ভুলিয়া যাওয়া চলে না। কিন্তু এখন তাহাতে নূতন করিয়া ইন্ধন জুগাইতেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদের নবরূপে প্রত্যাবর্তন। উগ্র হিন্দুত্ববাদ আজ ঠিক উগ্র ইসলামের মতোই নিজেকে জাহির করিতে ব্যস্ত। আর এই প্রতিযোগিতামূলক মৌলবাদের দ্রুত অগ্রসরে কেন্দ্রীয় ভূমিকা লইতেছে রাষ্ট্র। গত কয়েক বৎসরে সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ রাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন পাইয়াছে, দৈনন্দিন তুচ্ছতার ভিতরেও ধর্মকে প্রবেশ করাইয়াছে। একটি বিশেষ বুলি না বলিলে, একটি নির্দিষ্ট খাদ্য গ্রহণ করিলে, প্রকাশ্য গণপ্রহারে প্রাণ যাইতেছে। কেহ যদি বলেন, সংখ্যাগুরুর এই মৌলবাদ আসলে সংখ্যালঘুর মৌলবাদের প্রতিক্রিয়া, তাঁহাকে মনে করাইয়া দিতে হয়, ইহা কোনও সমাধান নহে, বরং সমস্যাটিরই আরও তীব্র রূপ। তাহার কারণ, সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ ও সংখ্যালঘুর মৌলবাদ একে অপরের হাত ধরিয়া চলে, তাহারা পরস্পরের শত্রু নহে, পরস্পরের বন্ধু— এ বাড়িলে ও-ও বাড়ে। ইহাকেই বলা যায়, ‘মিরর এফেক্ট’। জ়াইরার প্রস্থান তাঁহার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত এই দুর্ভাগ্যময় নিয়তির দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement