নভেম্বরে মার্কিন দেশের ভোট এ বার সারা বিশ্বের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ
Donald Trump

গণতন্ত্রের বিপক্ষে না পক্ষে?

আমেরিকা জুড়ে এখন সর্বাঙ্গীণ তাণ্ডব এই নির্বাচনের প্রচার ঘিরে।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৩৯
Share:

ট্রাম্প আর বাইডেন।

আর দুই মাস। শেষ দুই মাস। নভেম্বরের ৩ তারিখে যে ভোটটা আমেরিকায় হতে চলেছে— কেবল আমেরিকা কেন, দুনিয়ার অনেকের কাছেই সেটা প্রবল গুরুত্বপূর্ণ, প্রায় একটা যুগসন্ধির মতো। সামনের দুই মাস আশা-আশঙ্কায় শ্বাসরুদ্ধ থাকবেন আমেরিকানদের মতো বহু অ-আমেরিকানও— কী হয় কী হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই (বাঁ দিকে) জিতবেন? না, বাইডেন (ডান দিকে) প্রেসিডেন্ট হবেন? চার বছরে ট্রাম্প গণতন্ত্রের গোড়া ধরে টেনে উপড়েই ফেলেছেন প্রায়, শেষটুকু কোনওক্রমে মাটিতে লেগে আছে। সেটা কি শিকড় ছিঁড়ে উঠিয়ে আনার পক্ষেই মত দেবেন প্রাচীনতম গণতন্ত্রের নাগরিকরা? না কি, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে পছন্দ হোক না হোক, অন্তত ট্রাম্পকে সরানোর জন্য তাঁদের ভোট দেবেন বেশির ভাগ মানুষ?

Advertisement

আমেরিকা জুড়ে এখন সর্বাঙ্গীণ তাণ্ডব এই নির্বাচনের প্রচার ঘিরে। ভোটের প্রচার সব সময়েই উচ্চগ্রামে বাঁধা হয়, কিন্তু এ বার যেন সব ইতিহাস ছাপিয়ে গিয়েছে ভোটজ্বরের তাপমান। পরিবারের মধ্যে ভাঙন ধরে যাচ্ছে, বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। চেনাশোনাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ রাখতে হচ্ছে, ভোট নিয়ে মতের আদানপ্রদান হল কি কুরুক্ষেত্র বেধে যাচ্ছে। নেতারাও যাকে বলে উত্তুঙ্গ উত্তেজিত, যাকে বলে ‘হাইপার’। ক্ষমতাসীন ট্রাম্প বলছেন, কেবল দ্বিতীয় বার কেন, আরও বারো বছর, অর্থাৎ চার টার্ম, তিনি প্রেসিডেন্ট থেকে যেতে পারেন। (যদিও মার্কিন সংবিধান দুই টার্মের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে দেয় না।) নিজের বিরুদ্ধে ভোট যেতে পারে বলে নির্বাচনের আগে পোস্টাল ব্যালট বা ডাকযোগে ভোট দেওয়াই বন্ধ করার পক্ষে তিনি। গত চার বছর নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে করতে, সাংবিধানিক এক্তিয়ারের বাইরে যেতে যেতে এতই আত্মবিশ্বাসী তিনি যে বলেই দিচ্ছেন সোজা— গণতন্ত্র? সংবিধান? নৈতিকতা? ফুঃ! একের পর এক শহরে বর্ণবিদ্বেষী সংঘর্ষ, রাজনৈতিক সংঘাত, হতাহতের সংখ্যা যত বাড়ছে, ট্রাম্প ততই উৎফুল্ল। হিসেব পরিষ্কার। যত অশান্তি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, তাঁর ভোট-পাল্লা ততই ভারী!

অর্থাৎ তিনি দেখাতে চান আমেরিকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তলানিতে ঠেকেছে, সারা দেশ ‘সমাজবিরোধী’তে ভরে গিয়েছে। কালোরা, হিসপ্যানিকরা, অভিবাসীরা, এবং তাদের মাথায় তোলা লিবারালরা আমেরিকাকে এই পাতালেই টেনে নামাতে চায়। এদের হাত থেকে নিষ্কৃতির এক ও একমাত্র পথ— ট্রাম্পকেই আবার জিতিয়ে আনা। তাই অশান্তি বাধানোয় তাঁর আপত্তি নেই।

Advertisement

প্রশ্ন হল, তিনি তো কেবল তিনিই নন, তাঁর পিছনে দেশের এক বিরাট জনতা। তাঁরা কী ভাবছেন? তাঁরাও কিন্তু ট্রাম্পের মতোই ভাবছেন, গণতন্ত্র, নৈতিকতা, ও সব আর না ভাবলেও চলবে। দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর প্রতি, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ধারণাটার প্রতি একটা তীব্র বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে তাঁদের। এখানেই আসল ভয়ের কথা। এটাই আমেরিকার এ বারকার ভোটের মূল থিম। গণতন্ত্রের পক্ষে? না বিপক্ষে? মানবসভ্যতার একবিংশ শতকীয় গন্তব্য কি তৈরি করে দিতে চলেছে নভেম্বরের ভোট?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা বিরাট পর্ব— দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পার্টি রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের ‘ন্যাশনাল কনভেনশন’। সেখানে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা এবং তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমর্থক প্রচার-বক্তৃতা দেন। এটা দলীয় কার্যক্রম। ফলে দলের তরফেই আলাদা জায়গা ঠিক করা হয় কনভেনশন-এর জন্য। এ বার ঘটল একটা আশ্চর্য ঘটনা। ডেমোক্র্যাট দলের জো বাইডেন, কমলা হ্যারিস, বারাক ওবামা, মিশেল ওবামা প্রমুখ যা বলার বললেন খালি হল-এ দাঁড়িয়ে। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প? তিনি বললেন হোয়াইট হাউস-এর মধ্য থেকেই। প্রেসিডেন্ট-এর আসন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ষোলো কলা পূর্ণ হল। আজকাল যেমন অনেক গণতন্ত্রেই নেতা ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা দল আর রাষ্ট্র একাকার করে দিতে তৎপর, ট্রাম্প তাঁদের দেখিয়ে দিলেন, কত দূর নিয়ে যাওয়া যায় এই অন্যায় কারবারের স্পর্ধা।

বক্তৃতাটিও মনে রাখার মতো। তথ্য-পরিসংখ্যানের তোয়াক্কা না করে অসত্য কথা বলতে কোনও দিনই তাঁর জুড়ি নেই, করোনা-পর্বে তো আরওই নয়। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এত ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলছেন, এমনটাও সচরাচর ঘটে না। এই যে মিথ্যের বন্যা, এও কিন্তু রাজনীতির সচেতন ঘরানা। ক্ষমতা দখল ছাড়া আর কোনও বৃহত্তর বা মহত্তর লক্ষ্য নেই, তার জন্য যে কোনও পথ অবলম্বন করা চলে, নৈতিকতার বস্তাপচা বুলিকে বর্জন করা চলে— এটাই সেই নিয়োলিবারাল রাজনীতি, যা নিয়োলিবারাল অর্থনীতির দোসর। গণতন্ত্রে ‘প্রতিনিধিত্বমূলক’ (রিপ্রেজ়েন্টেটিভ) রূপটি এর তলায় পিষে যায়, সেটাই এই রাজনীতির বাঞ্ছিত। ফলে, যা বাইরে থেকে দেখতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন, তার গভীর তলে যে অ-গণতন্ত্র, তার নকশাটা পরিষ্কার চোখের সামনে ফুটে উঠছে— আশ্চর্য এই মার্কিন ভোটের আলো!

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে ‘আর এক রকম’ গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা, যেমন করছে রাশিয়া কিংবা চিন— নিয়োলিবারাল রাজনীতির অভিলাষ এটাই। তাই, বুঝতে অসুবিধে নেই কেন ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের হয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন রাশিয়ার নতুন ‘জ়ার’-প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০২০ সালেও তিনি তৎপর, শোনা যাচ্ছে। অবশ্য ট্রাম্প নিজের প্রেসিডেনশিয়াল ক্ষমতা দিয়ে নিজেই অনেকটা করে নিতে পারছেন এ বার— ‘ইলেকশন ইন্টারফিয়ারেন্স ২.০’ যার নাম হয়েছে আপাতত।

স্বভাবতই, প্রাক্তন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তৃতাটিও এ বার ঐতিহাসিক। অসামান্য বাগ্মী ওবামা যেন তাঁর ‘বাগ্মিতা’র অস্ত্রগুলো এ যাত্রা সরিয়ে রাখলেন। কাঠিন্যময়, হাসিচ্ছটাহীন স্পষ্টতায় সহজ ভাবে জানিয়ে দিলেন— ২৪৪ বছরের গণতন্ত্রের দেশে ট্রাম্প এখন জাতীয় শত্রু। যে কোনও বিদেশি শত্রুর থেকেও বিপজ্জনক। অভূতপূর্ব পরিস্থিতি, তাই অশ্রুতপূর্ব ভাবে সরাসরি আক্রমণ করলেন বর্তমান প্রেসিডেন্টকে। এই প্রথম তিনি কোনও স্বভাবসিদ্ধ আশাবাদ দিয়ে বক্তব্য শেষ করলেন না। সিভিল রাইটস আন্দোলনের উত্তরাধিকার মনে করিয়ে, গণতন্ত্রের তীব্র যন্ত্রণাময় যাত্রার কথা মনে করিয়ে দিলেন, কিন্তু কোনও আশ্বাসবাক্যে পৌঁছলেন না। গম্ভীর সতর্কবার্তা তাঁর: ‘‘এনি চান্স অব সাক্সেস ডিপেন্ডস এনটায়ারলি অন দি আউটকাম অব দিস ইলেকশন’’, এর পর কী হবে তা ভোটের ফলের উপরই নির্ভর করবে। লক্ষ না করে উপায় নেই, বাইডেন বা কমলা হ্যারিস যখন ‘সোল অব আমেরিকা’ বা সে দেশের এত দিনের অস্তিত্বের মূলের উপর জোর দিচ্ছেন, ওবামা রাখঢাক না করে বলছেন ‘সরকারের যে সিস্টেম’, সেটাই এখন প্রবল সঙ্কটগ্রস্ত। ‘‘বর্তমান সরকার দেখিয়ে দিয়েছে, ক্ষমতার লোভে গণতন্ত্রকে ছিঁড়ে টুকরো করতে সে প্রস্তুত।’’ সুতরাং, এখন আর কোনও একটা-দুটো ‘পলিসি’ বা নীতি বা সংস্কারের বিষয়ে আলোচনার পরিসর নেই, এখন ‘সিস্টেম’-এর মূলটা নিয়েই প্রশ্ন। কে সেটা রাখতে চায়। কে চায় না।

এই জন্যই মনে হচ্ছে, এ বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেন যুগসন্ধির মতো গুরুতর। যাঁরা বামঘেঁষা, কিংবা অধিকার আন্দোলনের লড়াকু মুখ, তাঁদের প্রতি মধ্যবাদী লিবারালদের তাই এ বার বিশেষ অনুরোধ— আগে গণতন্ত্রকে রক্ষা করা হোক, ‘সিস্টেম’-কে বাঁচানো হোক, শুভবোধের সলতেটাকে আগে ঝড়ের ঝাপ্টা থেকে আড়াল করা হোক, বাকি কাজ পরে। সলতে যদি টেকে, আলো পরেও জ্বালানো যাবে। বাকি যুদ্ধ পরেও লড়া যাবে। নোম চমস্কি র্যাডিকাল বামবাদী ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবেই পরিচিত, কিন্তু তাঁরও তাই সনির্বন্ধ অনুরোধ, আর সব ভুলে ভয়ঙ্করকে ঠেকাও, দেশের রাজনীতিকে বাঁচাও— ‘‘ইউ ভোট আগেনস্ট দি ওয়ার্স্ট।’’ একমাত্র তা হলেই ‘‘ইউ কিপ দ্য প্রেশার অ্যান্ড অ্যাকটিভিজ়ম গোয়িং।’’

না, গণতন্ত্র বস্তুটাকে ত্রুটিহীন কিংবা অভ্রান্ত নিশ্চয়ই বলা যাবে না। আমেরিকা কিংবা অন্যান্য গণতন্ত্র আমাদের ইতিমধ্যে বেশ করে বুঝিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্রের পথেই গণতন্ত্রের সর্বনাশ ডেকে আনা যায়, আর সেটাই হয়তো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। কিন্তু, তবু— এর পরও একটা তবু আছে। মানুষের প্রতি সুবিচার আর মানুষের অধিকারের কথা যদি ভাবি, এটা ছাড়া আর কোনও মডেল কি আমাদের সামনে আছে আদৌ?

তীক্ষ্ণভাষী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ছিলেন রক্ষণশীল, কিন্তু একটা মোক্ষম কথা বলেছিলেন তিনি। সব খারাপ শাসনপদ্ধতির মধ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র হল গিয়ে পদ্ধতি হিসেবে সবচেয়ে কম খারাপ (‘লীস্ট ব্যাড’): ‘‘অল আদার ফর্মস অব ডেমোক্র্যাসি, অ্যান্ড অল ফর্মস অব নন-ডেমোক্র্যাসি আর নট গুড।’’ সেটুকু বাঁচানোর জন্য— যেটুকু এগনো গিয়েছে, সেটুকুকেই রক্ষা করার লড়াই এখন। বাকি কথা পরে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement