ফাইল চিত্র।
চল্লিশ বৎসর পূর্বে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘাত বিষয়ক সংবাদপত্র প্রতিবেদনে চোখ রাখিলে চমৎকৃত হইতে হয়। আজিকার দ্বন্দ্বের সহিত তাহার অদ্ভুত মিল। চার দশক অতিক্রান্ত হইলেও সংঘাতের রূপটি তেমন পাল্টায় নাই। প্রতিবেদক জানাইতেছেন, পূর্বাঞ্চলে ম্যাকমাহন রেখাকে বৈধ সীমান্তরূপে মর্যাদা দিতে ১৯১৪ সালের যে শিমলা চুক্তির উল্লেখ করিয়া থাকে ভারত, চিন নাকি তাহাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করিবার মতো এক ‘ঐতিহাসিক দলিল’-এর সন্ধান পাইয়াছে।
তাহাদের দাবি, উক্ত সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হেনরি ম্যাকমাহন এক সামান্য সীমানার প্রস্তাব করিয়াছিলেন, পরবর্তী কালে ‘নকল নথি’ বানাইয়া তাহাকেই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বলিয়া ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। বিদেশমন্ত্রী নরসিংহ রাও নাকি ‘ঐতিহাসিক নথি মিলাইয়া দেখিতে রাজি’ হইয়াছেন। এই সকলই অবশ্য চিনের বর্ণনা, সত্যাসত্য বিচার করিয়া দেখিতে হইবে। কিন্তু, এখানে সত্য অপেক্ষাও অধিক জরুরি কিছু বলিবার আছে। এক্ষণে গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষবিরতির পরে দুই দেশের যে রূপ বিবাদ জারি আছে, প্রতিবেদনটি সর্বাগ্রে সেই প্রসঙ্গ স্মরণ করাইয়া দেয়। তৎকালের ন্যায় এই বারেও দুই প্রতিবেশীর ভিতর বিশ্বাসযোগ্যতার কোনও স্থান নাই। সীমান্ত হইতে ক্রমশ পিছু হটিবার দাবি করিয়াছে চিন, বারংবারই উহা ‘যথেষ্ট নহে’ বলিয়া জানাইয়াছে ভারত। একের পর এক বৈঠক হইতেছে, কিন্তু সীমান্ত লইয়া মতবিরোধ মিটিবার কোনও লক্ষণই দেখা যাইতেছে না। চলিতেছে পরস্পর দোষারোপ, বাড়িতেছে অবিশ্বাসের মাত্রা। আপনাপন ফৌজ বসাইয়া সীমান্তে তৎপরতার ঘাটতি নাই কোনও পক্ষেই।
এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটির দীর্ঘ ইতিহাস বাদানুবাদেরই। ১৮৩০ ও ১৮৪০-এর দশকে সৈন্য প্রেরণ করিয়া লাদাখ ও তিব্বত দখল করিয়াছিল শিখ সাম্রাজ্য। পাল্টা লেহ দখল করিয়াছিল চিনা বাহিনী। ১৮৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শান্তি স্থাপনে দুই পক্ষের ভিতর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই শতকেই আরও দুই বার সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তিতে চিহ্নিত হয় জনসন রেখা ও ম্যাকার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড রেখা। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভাবে এই রেখার হিসাবেই চলিত ব্রিটিশ ভারত। স্বাধীনতার পর যখন সকল সীমান্ত যথাযথ ভাবে চিহ্নিত করিতে বলিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, তখন আকসাই চিন ‘অনির্দিষ্ট’ বলিয়া পরিগণিত হইল। ইহার পর হইতে কেবল এই অঞ্চল নহে, অসম (বর্তমানে অরুণাচলপ্রদেশ) সীমান্তে ম্যাকমাহন রেখায় এবং সিকিম সীমান্তে দ্বন্দ্ব চলমান। উত্তাপ বাড়িলে নানা সময়ে সেই দ্বন্দ্ব সংঘাতের আকার ধারণ করিয়াছে; ১৯৬২ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী একাধিক সংঘর্ষ তাহার ফলাফল, সাম্প্রতিকতম নাট্যটি গালওয়ান-মঞ্চে অভিনীত হইতেছে।
চিনা সেনা বহু বার ভারতীয় ক্ষেত্রের ভিতর অনধিকার প্রবেশ করিয়াছে, তাহাকে দখলের উদ্দেশ্যে। ভারতের তরফেও এমন উদ্যোগ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বলিলে ভ্রম হইবে। দুই তরফে প্রণোদনেরও অভাব নাই। সুতরাং, সন্ধি স্থাপনের প্রচেষ্টা পুনঃপুন মঞ্চস্থ হইলেও শেষাবধি বিরোধে বিরাম দেখা যায় নাই।
সংঘাতের মূল কারণটি ভারত ও চিন দুই রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারে নিহিত। উভয়ই রাজনৈতিক ঐতিহ্যে সম্প্রসারণবাদ বহন করিতেছে। দুই পূর্বসূরি, ব্রিটিশ ও ছিং সাম্রাজ্য কোনও দিনই ভূমি দাবি করিবার বিষয়ে আপস করিতে রাজি ছিল না। পরবর্তী কালে দুই চিনা প্রজাতন্ত্রও সীমান্ত সংলগ্ন ক্ষুদ্র এলাকাগুলি আত্তীকরণ করিবার পক্ষেই ছিল। অপর পক্ষে, স্বাধীন ভারতও জন্মলগ্নেই দেশীয় রাজ্যগুলিকে অঙ্গীভূত করিবার ব্যবস্থা করে। সমস্যা হইল, দুই রাষ্ট্রের কোনওটিরই পরিধি নির্দিষ্ট ছিল না, কালে কালে তাহা পাল্টাইয়াও যাইত।
রাজনৈতিক শক্তির জোরে তাহারা যে ভাবে আপনাপন ক্ষেত্র সামলাইতে সক্ষম হইত, সেই ভাবেই নির্ধারিত হইত দুই প্রতিবেশীর সীমান্ত। পরিস্থিতি পাল্টাইল আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের যুগে। ভারত ও চিন উভয়ই আইনগত ভাবে সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হইল, ভুলিয়া গেল যে, সীমান্তবর্তী এলাকার উপর সার্বভৌম অধিকার দাবি করিবার এক্তিয়ার তাহারা এত কাল মানিয়া আসে নাই। অর্থাৎ চলমান এই সীমান্ত-বিবাদ আসলে দূর অতীতের বিষয় নহে, নিকট অতীত হইতে বিচ্যুত না হইতে পারিবার ত্রুটি। ঔপনিবেশিক যুগের ঐতিহ্য হিসাবেই বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছায়া বহন করিতেছে ভারত ও চিনের ‘পরিবর্তনশীল’ সীমান্ত।
যৎকিঞ্চিৎ
অমন পিলে-চমকানো ভিলেন অমরীশ পুরী, তিনিও কিনা পায়রাদের দানা খাওয়াতেন। প্রধানমন্ত্রী দানা খাওয়ান ময়ূরকে। লোককল্যাণ মার্গের যে রাস্তাতেই প্রধানমন্ত্রী হাঁটেন, যে ঘরেই বসে আপনমনে দেশকল্যাণের কথা ভাবেন, সেখানেই পেখম মেলে দাঁড়িয়ে থাকে ময়ূর আর ক্যামেরা হাতে ফটোগ্রাফার— এ হয় সমাপতনের ঠাকুর্দা, নয় ময়ূরগুলো এ বার হিন্দি সিনেমায় নামবে। প্রশ্ন, প্রকৃত ময়ূর আর পুচ্ছধারী কাকের মধ্যে ফারাক বোঝার ক্ষমতা ভারতীয়দের আছে?