ফাইল চিত্র।
যে সব সৌভাগ্যবান সেখানে গিয়েছেন, তাঁদের উদ্ভাসিত মুখের বর্ণনা শুনেছি কী ভাবে স্ট্র্যাটফোর্ড-অন-আভন’-এ সাজানো আছে মহাকবি শেক্সপিয়রের বাড়ি। যেমন ছিল ঠিক তেমন ভাবেই। ২০১২ সালে সতীনাথ ভাদুড়ির জন্মশতবর্ষে গিয়েছিলাম পূর্ণিয়া। সতীনাথের বসতবাড়িটি কিনেছেন আর্মিতে কর্মরত এক অবাঙালি ভদ্রলোক। বাড়িটির যে অংশে বাংলা সাহিত্যের এই মহীরুহ শেষ জীবনে বাস করতেন, সেইটুকু জায়গা তাঁরা সাজিয়ে রেখেছেন ঠিক যেমন ছিল। যিনি কিনেছিলেন, তিনি মারা গিয়েছেন। তাঁর পুত্র বর্তমান ছিলেন। বাংলা পড়তে না পারা সেই মানুষটি কী যে যত্নে আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন কোথায় সতীনাথ বসে লিখতেন, বাগানে কোন গাছটার কথা তাঁর কোন উপন্যাসে আছে, এমনকি শেষ জীবনে কোন চারপাইয়ে বিছানা পেতে শুতেন, কোন থালাবাসনে খেতেন। নগদ টাকায় কেনা সম্পত্তির একটা বড় অংশ না-বুঝতে-পারা একটি ভাষার এক জন বিখ্যাত সাহিত্যিকের প্রতি শ্রদ্ধাবশত যেমন ছিল, তেমন ভাবেই রক্ষা করছেন। দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদিবাড়ি। তাঁর জন্মের ঘর, উঠোন, তাঁর লেখার সামান্য জায়গাটুকুও কী যত্নে আর গৌরবে রক্ষা করছেন সেই গ্রামের সাধারণ মানুষজন।
ভারতে রবীন্দ্রনাথ বলে এক জন বিরাট মাপের মানুষকে দিয়ে বহু বিদেশি, আর এ দেশের অন্য ভাষাভাষীরা বাংলাকে চেনেন। বরং সঙ্কটকালে যেমন লোকে নিজের সঞ্চিত সম্পদ হাতড়ে দেখে তেমনই বিশ্বময় অতিভোগ ও অতিব্যবহারের তীব্র সঙ্কটে পৃথিবীর অনেক মানুষ নতুন করে দুই ভারতীয় মনীষার শরণাপন্ন হচ্ছেন আবার, তার এক জন রবীন্দ্রনাথ— এতে কোনও অতিরেক নেই।
এই রবীন্দ্রনাথ নিজের সময়ের থেকে অনেক দূর পর্যন্ত এক সময়ের দ্রষ্টা। বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য যুদ্ধজীর্ণ পৃথিবীতে বড় উৎকণ্ঠা নিয়ে লেখায়, কথায়, ভাবনা ও জীবনচর্যায় ‘সভ্যতা’র ব্যাধি নিরাময় করার ব্যাকুল চেষ্টা করেছেন তিনি। কথা বলেছেন পৃথিবীর নানা দেশে সমসময়ের অন্যান্য যুদ্ধবিরোধী চিন্তাবিদের সঙ্গে। লিখেছেন সেই হিংস্রতার স্বরূপ ও তার উৎকট বিপদ বিষয়ে। কোনও সন্দেহ নেই যে, সেই বিপদের এক চূড়ান্ত চেহারার মধ্যে আজ এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব। ‘‘অনতিপ্রয়োজনীয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলা যখন দেশসুদ্ধ সকল লোকেরই সাধনা হয়, তখন বিশ্বব্যাপী দস্যুবৃত্তি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বস্তুগত আয়োজনের অসঙ্গত বাহুল্যকেই যে সভ্যতার প্রধান লক্ষণ বলে মানা হয়, সে সভ্যতা অগত্যাই নরভুক।’’ ১৯২৫ সালে ‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়েরি’-র এই কথাটি, নিঃসন্দেহে লিখনকালের চেয়ে অনেক বিকট বাস্তব হয়ে উঠেছে আজ। দখলদারির হিংসা কণ্টকিত ‘সভ্যতা’ আজ সত্যিই নরভুক হয়ে উঠেছে। তাই হয়তো, পুরনো বাতিস্তম্ভটির কাছে নতুন করে আলো খুঁজছি আজকের আমরা। নতুন প্রজন্মও প্রায় অপঠিত রবীন্দ্ররচনার কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসছে পথ বুঝবার, খুঁজবার আশায়।
ঠিক তখনই দেখছি, দখলদারিত্বে আক্রান্ত স্বয়ং সেই রবীন্দ্রনাথই। সেই আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে তাঁরই নিজ হাতে গড়ে তোলা শিক্ষাকেন্দ্র ‘বিশ্বভারতী’র নাম দিয়ে। ধনিক-বিশ্বময় ব্যাপ্ত যুদ্ধ প্রস্তুতির লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে, শান্ত সংযত ও সৌন্দর্যময় একটি নীড় তিনি গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। চাইছিলেন, তরুণ ছাত্রদের হৃদয়ে দেশ ও দেশের বাইরের পরিচিত সমস্ত শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকে একত্র মিলিত করতে, বিশ্বের সঙ্গে এক অপূর্ব সম্বন্ধের বোধ গভীর করে গেঁথে দিতে।
অথচ আজ সভয়ে প্রত্যক্ষ করি যে, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দখল হতে বসেছেন লুটের বাজারে। ‘বিশ্বভারতী’ নাম এক ব্যঙ্গের মতো হয়ে দাঁড়াল সেখানে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নদেখা ‘শান্তিনিকেতন’ থেকে বিতাড়িত হতে চলেছেন সেই মানুষরা, যাঁদের সঙ্গে বিদ্যার্থীদের সবচেয়ে বেশি করে পরিচিত করাতে চেয়েছিলেন এখানকার প্রতিষ্ঠাতা। যে মাটির সঙ্গে, মাটিলিপ্ত মানুষদের নিত্যজীবন ও কাজকর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ চেয়ে তিনি তৈরি করলেন শ্রীনিকেতন, শুরু করলেন বনমহোৎসব, বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণের মতো উৎসব, যেখানে শিক্ষা তার সীমানা ব্যাপ্ত করে দেয় নিজের সমগ্র পরিপার্শ্ব পর্যন্ত, সেই মাটিকে গণ্ডি কেটে কেবল একটি ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র খোপের মধ্যে ঠেসে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
‘সভ্যতা’র যে ব্যাদিত হাঁ-মুখ সব কিছুকে দখল করতে চায়, ‘হয় আমি সমস্তটা পাব, না হলে ধ্বংস করে দেব’ এই যে শক্তির আকাঙ্ক্ষা, সহজ প্রসারিত প্রান্তর, শস্যখেতকে ‘নিজের’ না করতে পারা অবধি যা আগ্রাসী, মুক্তধারা নদী আর পশ্চিম আকাশের সূর্যপটের মুখের ওপর ‘বিকটস্পর্ধার মতো ডানামেলা’ যান্ত্রিক বিকারকে যাঁরা ‘প্রাকৃতিক মিলনের আনন্দের ওপর ক্ষমতার জয়’ বলে জানেন, তাঁদেরই শক্তি আজ শান্তিনিকেতনের মুক্ত শিক্ষার আলো হাওয়ার মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষকুঁড়িগুলিকে অবরুদ্ধ বন্দি করতে উদ্যত।
অথচ, শান্তিনিকেতন কোনও দিনই তো আর পাঁচটা ইউনিভার্সিটির মতো ছিল না। হওয়ার কথাও ছিল না। সে অন্য রকম। অন্য রকম হওয়ার জন্যই একে তৈরি করা হয়েছিল।
এ কথা ঠিক যে, সেই চেষ্টা আজ শুরু হয়নি। কিন্তু আজকে সেটা যে চূড়ান্ত কুশ্রীতা নিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে, যেমনটি আগে কখনও হয়নি। যে স্পর্ধায় রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনদর্শনকে অগ্রাহ্য করে বিশ্বভারতী নামের সরকারি তকমা আস্ফালিত হল, তাতে রবীন্দ্রনাথ কোথায় রইলেন? রবীন্দ্রনাথ কি কেবল একটি প্রজেক্টের নাম, যেখানে ‘মোদের তরুমূলের মেলা/ মোদের খোলামাঠের খেলা’র দিগন্তবিস্তারি মুক্তির ইশারাটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল মেপে মেপে ‘বিশ্বভারতীর জমি’র হিসেবের আবর্তে? উপাসনা মন্দিরে ছাত্রদের কাছে দিনের পর দিন বিরাটের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারার যে অপূর্ব মুক্তির বোধ জাগিয়ে তোলা, সে কি কেবল ‘শান্তিনিকেতন বক্তৃতামালা’ চিহ্নিত একটি সঙ্কলনমাত্র হয়ে রইল? ‘বিশ্বভারতী সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’তে কেবল তৈরি হয়ে উঠল এক বহুমূল্য সাইনবোর্ডের রবীন্দ্রনাথ? শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ তবে থাকবেন পাঁচিলে মোড়া ‘বিশ্বভারতী’ সুরক্ষাবাহিনীর পাল্লার বাইরে কোথাও?
আর আমাদের মতো মানুষ, যারা শান্তিনিকেতনী নই, বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী নই, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা আমরা যারা ‘বাইরের লোক’— আমাদেরও এক দাবি আছে শান্তিনিকেতনের ওপর। জোরালো সেই দাবি। আমরা এখানে সেই রবীন্দ্রনাথের স্থাপিত স্বপ্নকে দেখতে আসি, যাঁর ভাবনার মধ্যে, যাঁর সৃষ্টির মধ্যে অভ্রান্ত, গানে কবিতায়, স্থাপত্যভাস্কর্যে, আশ্রমজীবনে অমোঘ ভাবে রয়ে যায় এক উদার উন্মুক্ত শান্তিনিকেতন। যা নয় কেবল এক ভৌগোলিক সীমানাঘেরা স্থান।
আজ ভাবি, শান্তিনিকেতন ভাষণগুলির মধ্যে কোথাও কী করে লেখা থাকল এই কথা: ‘‘বাহিরও যদি শিক্ষাদানের চেয়ে বেশি দূরে গিয়ে পৌঁছয়, যখন সে আমাদের ওপর চেপে পড়বার জো করে, তখন তাকে একেবারে বরখাস্ত করে দিয়ে তার জাল কাটবার পন্থাই হচ্ছে শ্রেয়ের পন্থা?’’