বই, ভাল বই

কিন্তু এই সকল বই ও বিপ্লব আন্তর্জাল-পূর্ব এক ধূসর পৃথিবীর অভিজ্ঞান। সিপিআইএম রাজত্বেই দলীয় কর্মীদের পাঠাভ্যাস ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া পড়িতেছিল, আগ্রহীদের পাঠচক্রও কার্যত লুপ্ত হইয়া পড়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:১০
Share:

কর্মফল খণ্ডন করিতে কেহ কেহ অন্তিম দশায় শ্রীহরির নাম স্মরণ করেন। সিপিআইএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই দেবী বীণাপাণির শরণ লইয়াছেন। সংগঠনটি বই বিনিময় করিতে চাহে, তাহাদের দলীয় বিপণিতে পুরনো বইয়ের বদলে আগ্রহী ক্রেতা বা পাঠক পছন্দসই নূতন বই পাইবেন। উদ্যোগটি বৈপ্লবিক, সন্দেহ নাই। গত শতাব্দীর বিশের দশকে বেজিংয়ে এ হেন এক পুস্তকবিপণিতেই তরুণ মাও জে দং ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বইটি পাইয়াছিলেন। সে বই তখন চিনা ভাষায় সদ্য-অনূদিত। তাহারও ঢের আগে সুইৎজ়ারল্যান্ডে থাকার সময় রুশ তরুণ ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ জার্মান ভাষায় বইটি পড়িয়াছিলেন। পরে তিনি লেনিন নামে বহুলপরিচিত হইবেন। ১৯৫২ সালে স্প্যানিশ অনুবাদে ওই বই কিউবাতে আর এক পাঠকের হস্তগত হয়। তাঁহার নাম ফিদেল কাস্ত্রো। সিপিআইএমের যুব সংগঠন জানে, বিপ্লব ও বইয়ের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি।

Advertisement

কিন্তু এই সকল বই ও বিপ্লব আন্তর্জাল-পূর্ব এক ধূসর পৃথিবীর অভিজ্ঞান। সিপিআইএম রাজত্বেই দলীয় কর্মীদের পাঠাভ্যাস ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া পড়িতেছিল, আগ্রহীদের পাঠচক্রও কার্যত লুপ্ত হইয়া পড়ে। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি, ইত্যাদি আপ্তবাক্যও কেবল দেওয়াললিখনেই সীমাবদ্ধ থাকিত। জ্ঞানচেতনা নির্মাণের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হইয়া উঠিয়াছিল ক্যাডার তৈরির আখড়া। আগ্রহী পঠনতন্ত্র নহে, দলতন্ত্র বিস্তারেই তখন বঙ্গীয় কমিউনিস্টরা সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিলেন। পাঠাভ্যাস ‘অপর’কে বুঝিবার সামর্থ্য দেয়, কিন্তু দলটি তাহা রপ্ত করে নাই। যে কোনও বিরুদ্ধ মতকে সে প্রতিক্রিয়াশীল বলিয়া দাগাইয়া দিত। লেনিন পড়ো, ক্ষতি নাই। কিন্তু ট্রটস্কি বা প্লেখানভ? নৈব নৈব চ। সিপিআইএম যদি সত্যই বইয়ের হাত ধরিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইতে চাহে, তাহাকে সর্বাগ্রে পাঠকের অধিকার স্বীকার করিতে হইবে। সে গোর্কি হইতে গোলওয়ালকর যাহা খুশি পড়িবে, ভিন্নমতে ঠোক্কর খাইতে খাইতেই তাহার বিচারধারাটি পুষ্ট হইবে, সিদ্ধান্ত লইতে শিখিবে। পাঠাভ্যাসে ঋদ্ধ বিপ্লবী পার্টিতে বিতর্ক থাকিবে, ফতোয়া নহে!

ইহাই বাঁচিবার পথ। মার্ক্স স্বয়ং নিজেকে বইপোকা বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলেন। শেক্সপিয়র হইতে শিলার, সফোক্লেস হইতে বায়রন, সব গোগ্রাসে পড়িতেন তিনি। ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মার্ক্সবাদীরা এককালে প্রচুর পড়িতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সে নদী অনেক কাল আগেই মরুপথে তাহার ধারা হারাইয়াছে। আর এখন তো পড়াশোনা বস্তুটিই বিস্মৃতপ্রায়। পাঠাগারের ধারাটি শুষ্ক, বইয়ের দোকানগুলি মৃতপ্রায়, ঘরে ঘরে টিভি চ্যানেল, হাতে হাতে মোবাইল টেলিফোন। এই বাস্তবকে অস্বীকার করিলে যুব সংগঠন অগ্রসর হইতে পারিবে না, এই নূতন অভ্যাসকে কাজে লাগাইতে হইবে। যে নূতন প্রজন্ম মোবাইলে বই পড়ে, তাহাদের সহিত সংযোগ ঘটাইতে চাহিলে তাহাদের মনের মতো প্রযুক্তির সাহায্য লইতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড বা দাস ক্যাপিটাল পুঁথির আকারে, না ছাপা বইয়ের আকারে, না মোবাইলের পর্দায় রহিয়াছে, সেটি বড় কথা নহে। পড়িবার অভ্যাস তৈয়ারি করার কাজটিই আসল। কাজটি কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নহে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement