বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারের পতন বলিতেছে, অর্থনীতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ২০০৩ সালে যখন গোটা দুনিয়ায় সার্স সংক্রমণ ছড়াইয়া পড়ে, শেয়ার বাজারে তখন এই কাঁপুনি ধরে নাই। বরং ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেম্যান ব্রাদার্স-এর পতন-পরবর্তী কম্পাঙ্কের সহিত ২০২০ সালের মিল অনেক বেশি। অর্থনীতি লইয়া চিন্তার কারণ বিলক্ষণ আছে। এই মহামারির প্রসার রুখিতে যে ব্যবস্থাগুলি করা হইতেছে, তাহার কোনওটিই অর্থনীতির পক্ষে ইতিবাচক নহে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়িয়া দোকান-বাজার বন্ধ; কলকারখানায় তালা পড়িতেছে; পর্যটক নাই; একের পর এক বিমান বাতিল হইতেছে, দেশের দরজা বন্ধ হইতেছে বিদেশিদের জন্য— অর্থাৎ, যে চাকাগুলির উপর ভর করিয়া অর্থনীতির গাড়ি চলে, করোনাভাইরাসের দাপটে সেগুলি অচল হইয়াছে। বাজার স্তব্ধ হইলে তাহার প্রত্যক্ষ প্রভাব এক দিকে পড়ে রাজকোষের উপর— কর আদায়ের পরিমাণ কমিতে থাকে; অন্য দিকে, বাজারের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়— এক বার চাহিদার অভাবে মার খাইলে সেই ঘাটতি পুষাইয়া ফিরিয়া আসা অনেক সংস্থার পক্ষেই কঠিন কাজ। সর্বাপেক্ষা চিন্তার বিষয়, ভাইরাসের দাপট কমিলেই যে অর্থনীতিও মাথাচাড়া দিয়া উঠিবে, সেই নিশ্চয়তা নাই। ফলে, বাজারের প্রতিক্রিয়াটি স্বাভাবিক এবং অনিবার্য।
এই অবস্থায় বাজারের ঘাটতি আংশিক ভাবে হইলেও পুষাইয়া দেওয়ার দায়িত্বটি সরকারের উপর বর্তায়। বিশ্বের বহু দেশের সরকারই ব্যয়বরাদ্দ বাড়াইয়াছে। ইহাকে কেন্সীয় ব্যবস্থাপত্র বলা চলে কি না, তাত্ত্বিকেরা সেই তর্ক করিবেন— কিন্তু, এই সময়ে সরকারের এই টাকাটি খরচ করা উচিত অর্থনীতিকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্যই। আর্থিক ভাবে বেকায়দায় পড়া সংস্থাগুলি এই ধাক্কা সামলাইতে অধিকতর মুশকিলে পড়িবে। তেমন সংস্থার জন্য ঋণ পুনর্গঠন ইত্যাদির কথা সরকারকেই ভাবিতে হইবে। বিশেষ ভাবে মনে রাখিতে হইবে অন্য একটি শ্রেণির কথাও— অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কথা। ভারতের ক্ষেত্রে এই কথাটির গুরুত্ব অপরিসীম। বাজার বন্ধ হইলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অধিকাংশ শ্রমিকের বেতনও বন্ধ। ফলে, তাঁহাদের অনেকেরই প্রাত্যহিক সংসার খরচটুকুরও সংস্থান থাকিবে না। এই মানুষগুলির কথা সরকারকেই ভাবিতে হইবে। আশা করা যায়, এই বিপুল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইয়া নির্মলা সীতারামনেরা রাজকোষ ঘাটতির ভাবনাকে সাময়িক ভাবে সরাইয়া রাখিবেন।
যে সব মানুষের দেহে পূর্ব হইতেই বিবিধ রোগব্যাধি আছে, করোনাভাইরাস তাঁহাদের ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী হইতেছে বলিয়া চিকিৎসকেরা জানাইতেছেন। কথাটি, কিমাশ্চর্যম্, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে দেশের আর্থিক অবস্থা পূর্ব হইতেই টলমল করিতেছে, এই ভাইরাসের ধাক্কায় তাহাদের বিপদ বহু গুণ বেশি। ভারত তেমন অর্থনীতির একটি মোক্ষম উদাহরণ। বিপুল মন্দার মুখে দাঁড়াইয়া আছে দেশ। বাজারে চাহিদা নাই, কর্মসংস্থান কমিতেছে। রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কোনও ভাবেই লক্ষ্যসীমায় বাঁধা সম্ভব হইতেছে না। এই অবস্থায় অর্থনীতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হইলে সেই ধাক্কা সামলানো যে কঠিনতর হইবে, তাহা নিশ্চিত। গত কয়েক বৎসরে অর্থনীতি যে ভঙ্গিতে পরিচালিত হইয়াছে, তাহাতে কোনও কিছুই আশা করা দুষ্কর। তবুও ক্ষীণ আশা, করোনাভাইরাস-জাত আর্থিক সমস্যার শাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার অর্থনীতির গভীর স্বাস্থ্যভঙ্গের বিপদটিকে ঢাকিতে চাহিবে না। এই অবস্থায় কী কর্তব্য, তাঁহারা যদি না জানেন, তবে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য লউন। কিন্তু, কিছুই হয় নাই, আমরাই সব সামলাইতে পারিব, এমন মিথ্যা অহঙ্কারের হাতে ভারতকে ছাড়িয়া দিলে বিপুলতর বিপর্যয় অপেক্ষা করিয়া থাকিবে।