আজকাল, মেয়েদের পক্ষে অনেক ‘হ্যাপেনিং’ বিজ্ঞাপন হচ্ছে। ক্যাচলাইনও আছে— আমরা নারী আমরা পারি। কিন্তু তার সঙ্গে পিতৃতন্ত্র যে ভাবে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাধীনতা, ফুরফুরে যাপনের নিয়ন্ত্রক হয়ে থাকে, এ সব বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল ক্যাম্পেনও সে পথেই চলে। সে দিন এক অল্পবয়সি সদ্য-বিবাহিতা চোখ বড়-বড় করে বান্ধবীকে বলছিল, ‘‘মিথ্যে বলব না, আমার শ্বশুরমশাই, বর যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয় আমাকে।’’
একটি বিজ্ঞাপনে ‘বোল্ড ইজ় বিউটিফুল’ বলে মেয়েদের আলোকিত করা হচ্ছে। ‘বোল্ডনেস’ তো পুরুষের সহজাত কবচকুণ্ডল। কাজেই তাদের জন্য আলাদা ভাবে আদিখ্যেতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মেয়েদের জন্য এ কথা বলা প্রয়োজন বইকি! গর্ভধারণের কারণে একটি মেয়ের পদোন্নতি, অ্যাপ্রাইজ়াল আটকে যাচ্ছে যখন, মেয়েটি পদত্যাগপত্র দিয়ে নিজেই একটি সেট-আপ খোলার ব্যবস্থা করে, মা হতে-চলা সেখানে মানসিক অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না এতটুকু!
হ্যাঁ, এটা বিজ্ঞাপন, এতে রুপোলি রেখা আছে বটে। কিন্তু প্রাণান্তকর অবস্থা সেই মেয়েটির, যে সংসার ও বাচ্চা সামলায়, চাকরিও করে। শতকরা একশো ভাগ মনোযোগ ব্যয় করতে চায় দু’জায়গাতেই। কতটুকু পারে, তার অন্তরাত্মা ভেঙে খানখান হয়ে যায় কি না, এ সব অন্য বেদনার প্রসঙ্গ। চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর আবহেও মার্গারেট অ্যাটউড-এর ‘দ্য হ্যান্ডমেডস্ টেল’-এ লেখা বাক্যগুলোই তো সত্যি: ‘‘ইটস ফরবিডন ফর আস টু বি অ্যালোন উইথ দ্য কমান্ডারস। উই আর ফর ব্রিডিং পারপাসেস।’’ আশ্চর্য কী, এই ডিজিটাল যুগেও কন্যাসন্তান জন্মানোর হার শোচনীয় ভাবে কমে যায়, কন্যাভ্রূণ হত্যার হার লাফিয়ে বেড়ে চলে।
দু’দিন আগেই, এক তরুণ অধ্যাপক ম্লান মুখে বলছিলেন, পড়াতে একটুও ভাল লাগছে না। কারণ তাঁর ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রীটি বিএ-তে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েও এমএ পড়তে পারছে না অভিভাবকদের তুমুল আপত্তিতে। এই তিন বছর সে তার সহপাঠীদের সঙ্গে একটিও কথা বলত না। ভয়-সঙ্কোচে বুজে থাকত গলা। শেষে উপায়ান্তর না পেয়ে ওই অধ্যাপককে বলেছিল, ‘‘আমি পরীক্ষা দেব না। যাতে আরও এক বছর লেখাপড়ার সঙ্গে জুড়ে থাকতে পারি।’’ শেষ পরীক্ষা দিয়েই বিয়ে হয়ে যায় ওর! শোনা গেল, ওই কলেজেই জ্ঞানচর্চায় উৎসুক বেশ কয়েক জন ছাত্রীর জন্য মোটেই দিগন্তের উদ্ভাস নেই, আছে ঘরকন্নার খুঁটিনাটি। বন্ধু অধ্যাপিকার মুখেও এমনই এক করুণ কাহিনি শুনলাম। তাঁর খাস মধ্য কলকাতার কলেজে একটি মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কেন? দাদার নিষেধ। দাদার বয়স? বাইশ। এই বয়সেই সে বাড়ির কর্তার পদটি বাগিয়ে নিয়েছে। প্রতিবেশ কী বলছে? বলছে, ঠিক তো, মেয়েদের অন্য রকম ভাবনা ভাবতে নেই।
আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই, প্রতিবাদী হতে। মেয়েরা ডালপালা মেলার আগেই বনসাই হয়ে যায়। তার ছবি আঁকা, লেখা, অভিনয় চলে দিনগত পাপক্ষয়ের সঙ্গে। জৌলুস নেবে দিনে দিনে। লেখিকারা আজও লেখার সময় লেখার টেবিল পান না। কবিতা সিংহ শুনেছি উনুনে ভাত বসিয়ে লিখে চলতেন। আর, পরিবারের জন্য রান্না চড়িয়ে বা বাচ্চার জন্য দুধ বসিয়ে কেউ যখন লেখার কাজ, মেধার বুনন বুনে চলেন, ক্যানভাসে আঁচড় কাটেন, সেই কষ্টসাধ্য কাজ কত দূর যেতে পারে? তাঁর মনের সবটুকু তো পাচ্ছে না তাঁর সৃষ্টি। সজাগ মস্তিষ্ক রান্না নষ্ট হতে দেয় না, তাঁকে বার বার উঠে দরজা খুলতে হয়। যাতে রমণীর গুণে সংসার সুখের হয়, তার জন্য পাশে সরিয়ে রাখতে হয় লেখার খাতা বা ছবির স্ক্র্যাপবুক।
এ ভাবে কি জাদুস্পর্শ পেতে পারে শিল্পীর নির্মাণ? শিল্পের মহৎ উত্তরণ আসবে কোত্থেকে!
এই প্রসঙ্গে অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীর ছোট একটা গদ্যাংশ পড়ে গায়ে কাঁটা দিল— ‘‘আজ সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা ছবি দেখতে যাব ভেবেছিলাম। অজিতদা বলেছিলেন, অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়াও। কী করে অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়াব? অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে রাত করে ফিরতে মানা আমার।... গৃহকর্মনিপুণা পাত্রীর জন্য বিজ্ঞাপন থাকে খবরের কাগজে। আর গায়ের কাপড় সরিয়ে দেওয়া মেয়ের ছবি সিনেমায়, পোস্টারে, ইদানীং থিয়েটারেও। অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়ানো মেয়েদের কে চায়?... তা ছাড়া সময় কই? সুতরাং আমি, মিসেস আর পি সেনগুপ্ত, এঁটো পেড়ে, চায়ের বাসন ধুয়ে, সোজা স্টেজে চলে যাব।’’
মনে পড়ছিল লিন্ডা নশলিনের কথা। কেন মহিলা শিল্পী মহৎ শিল্প নির্মাণে অক্ষম, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, পুরুষশিল্পী প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই তাঁর মেধার মধ্যে রহস্য ও অনন্যতা নিয়ে জন্মান। তাঁর বোহেমিয়ান যাপন তাই তাঁর টুপিতে সৃষ্টিশীলতারই পালক। উল্টো দিকে এক জন মহিলাশিল্পী তখন হয়তো-বা ভুরু কুঁচকে দেখছেন তাঁর তৈরি চিকেন স্যুপের রং ঠিকঠাক হল কি না! সত্যিই তো, প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী তো বোহেমিয়ান হবেনই, শিল্পের জীবন অত প্রথাসম্মত হতে পারে না। কিন্তু কী করে কোনও নারী চিত্রকর, কবি বা ঔপন্যাসিক বোহেমিয়ান হতে পারেন! শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত টহল দিয়ে, অভিজ্ঞতা চয়ন করে মাঝরাতে বাড়ি ফেরার পথে তিনি তো পুরুষের সুখাদ্য বনে যেতে পারেন। কিংবা ফিরে এলেও বাড়ির লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী, তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। তা হলে? নশ্বরতা পার-হওয়া অনন্তকে তিনি তাঁর কাজ দিয়ে ছোঁবেন কেমন করে? অন্তরায় আরও আছে— তিনি নিজেই। অকপট ভাবে, নির্দ্বিধ হয়ে নিজের শিল্পকাজ মেলে ধরতে তিনি নিজেই পারেন না। ‘সেল্ফ-সেন্সরশিপ’ তাঁকে পরোক্ষে পেড়ে ফেলে। আর, কে না জানে, ভয় বা সদাসতর্কতা থেকে কোনও মহৎ শিল্পকর্ম সম্ভব নয়?
বললে তাই ভুল হবে না, মহৎ সৃষ্টি শুধু পুরুষেরই সোনার অঙ্গুরি হয়ে রইল। নারীর জন্য থাকে পিটুলিগোলা জল। আজও।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।