১৮২৯ সাল, কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হলেন বীরসিংহের ঈশ্বর ও বিল্বগ্রামের মদনমোহন। দুই সহপাঠীর সে দিনের বন্ধুত্বই ক্রমশ বিকশিত হয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সমাজসংস্কারের সুদৃঢ় সহায়ক হয়ে উঠেছিল। মদনমোহন বিদ্যাসাগরের চেয়ে তিন বছরের বড় ছিলেন। দু’জনেই পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের কাছে সাহিত্য, ব্যকরণ, অলঙ্কার, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। যোগ্যতায় কেউ কারও চেয়ে কম ছিলেন না।
‘‘প্রথম পুরস্কার ইঁহাদের দু’জন ব্যতীত অপর কেহ পাইতে পারিত না।’’ তবে, মাত্র সতেরো বছর বয়সেই মদনমোহনের কাব্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটে তাঁর রচিত ‘রসতরঙ্গিণী’ ও ‘বাসবদত্তা’ অনুবাদ কাব্যের মধ্য দিয়ে। সংস্কৃত গদ্যে লেখা গ্রন্থের মূল ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে নিজের ভাষা ও সৌন্দর্য ভাবনায় কাব্যানুবাদ করে তার অধিকতর শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, রসতরঙ্গিণীর মূল শ্লোকটি হল নিম্নরূপ— ‘‘নৈতৎ প্রিয়ে! চেতসি শঙ্কনীয়ং/ করা হিমাংশোরাপি তাপয়ন্তি/বিয়োগতপ্তং হৃদয়ং মদীয়ং/তত্র স্থিতাত্বং পরিতাপিতাসি।’’
কবিবর মদনমোহনের অনুবাদটি নিম্নরূপ—‘‘ওলো ধ্বনি!কেন হেন পাইতেছ ভয়।
হিমকরে দাহ করে একি কভু হয়!
তব বিরহেতে তপ্ত মম বক্ষস্থল।
তাহাতে থাকিয়া তুমি তাপিতা কেবল।’’
১৮৪২ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই তিনি হিন্দু কলেজ সংশ্লিষ্ট পাঠশালা তথা বঙ্গবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রূপে যোগদান করেন। এর পর বারাসাত গভর্নমেন্ট বিদ্যালয়ে প্রথম পণ্ডিতের পদে এক বছর কাজ করেন। তার পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। সেখানে সাহেবদের তিনি সম্পত্তি সংক্রান্ত হিন্দু আইন পড়াতেন। ইংরেজ ছাত্রেরা তাঁকে এতটাই সম্মান করতেন যে বিল্বগ্রামের নাম শুনলেই করজোড়ে প্রণাম করত।
এর পর মদনমোহন কৃষ্ণনগর কলেজের প্রধান পণ্ডিত ও পরে বিদ্যাসাগরের সুপারিশে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক পদ লাভ করেন। তেমনই বেথুন সাহেব মদনমোহনের অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। এ পদ গ্রহণের জন্য বেথুনসাহেব প্রথমে মদনমোহনকেই অনুরোধ করেছিলেন। কারণ তত দিনে মদনমোহনের মধুর বাচনভঙ্গি, প্রাঞ্জল ব্যাখ্যার দক্ষতা, নিরহঙ্কারতা, শিশুসুলভ সরলতা শুধুমাত্র ছাত্রসমাজকেই নয়, শিক্ষাবিভাগের তৎকালীন অধ্যক্ষ বেথুনসাহেবকেও মুগ্ধ করেছিল।
১৮৪৭ সালে ‘সংস্কৃত মুদ্রাযন্ত্র’ প্রেস প্রতিষ্ঠার ভাবনাও ছিল মদনমোহনের। সে সময়ে ছ’শো টাকা ধার করে সংস্কৃত প্রেস প্রতিষ্ঠা করা ছিল রীতিমতো ঝুঁকির কাজ। মদনমোহন বন্ধু বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন সংস্কৃত মুদ্রাযন্ত্র। বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য প্রকাশনায় এই প্রেস নবদিগন্তের সূচনা ঘটেয়েছিল। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে পুরনো পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য সম্পাদনা মদনমোহনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি। শুদ্ধ বাংলা গদ্যে সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা প্রকাশ করেন তাঁরা। এই পত্রিকাতেই বাল্যবিবাহের দোষ নিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন বিদ্যাসাগর আর স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে একটি যুক্তিনির্ভর মনোগ্রাহী প্রবন্ধ লিখলেন মদনমোহন (১৮৫০ সালে)। এক দিকে, বন্ধু বিদ্যাসাগর হিন্দুশাস্ত্র ঘেঁটে খুঁজে চলেছেন বিধবাবিবাহের স্বপক্ষে শাস্ত্রের নিদান। অপর দিকে, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মদনমোহন মনোনিবেশ করেছেন বঙ্গনারীর শিক্ষাবিস্তারে।
বেথুন সাহেব যখন ফিমেল স্কুল খুললেন, তখন মদনমোহন নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও তখনকার সমাজের সকল বাধা, চক্রান্ত তুচ্ছ করে বেথুন সাহেবকে সহযোগিতা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম নিজের দুই মেয়ে ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে সেই স্কুলে ভর্তি করলেন। তখনকার দিনে সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁর এমন প্রগতিশীল ভূমিকা থেকেই বোঝা যায় নারীশিক্ষার প্রচলনে তিনি কতটা বদ্ধপরিকর ছিলেন। বেথুন সাহেবের স্কুলের ছাত্রীদের জন্য লিখলেন বাংলা প্রাইমার ‘শিশুশিক্ষা’ (তিন ভাগে)। বাঙালির ঘরে ঘরে ধ্বনিত হল তাঁর লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘প্রভাত বর্ণন’— ‘‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল..।’’ রবীন্দ্রনাথেরও শিক্ষার শুরু এই শিশুশিক্ষা দিয়েই। মদনমোহন রচিত শিশুশিক্ষায় মুখরিত বাঙালির শৈশব খুঁজে পেল ছন্দ-তাল-যুক্তাক্ষরের উদাহরণে উপদেশমূলক বাক্যবিন্যাস, পড়ার আনন্দ আর চিত্রকল্পনার অফুরন্ত সম্ভার। মদনমোহনের পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ও লিখলেন ‘বোধোদয়’, ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’।
বেথুন সাহেবের স্কুল থেকে মদনমোহন যখন চলে আসেন তখন তাঁর শূন্যতা পূরণের জন্য বেশ কয়েক জন অতিরিক্ত পণ্ডিতের প্রয়োজন হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায় সেই স্কুলে তিনি কতখানি জায়গা জুড়ে ছিলেন। বেথুনসাহেব তাঁর সম্বন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘‘He will never require service but service will ever require him.’’
এর পর মদনমোহন জজ পণ্ডিত হয়ে চলে আসেন মুর্শিদাবাদে। নানা জনহিতকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। কান্দি মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন তিনি সেখানেও স্কুল-কলেজ স্থাপন, রাস্তাঘাট ও একটি অনাথ মন্দিরও স্থাপন করেছিলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কর্তব্য শান্তিরক্ষা, তাই সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে মদনমোহন মাকালতোড় গ্রামের নির্মম মারণখেলা 'নকল যুদ্ধ' বন্ধের জন্য উদ্যোগী হন। সশরীরে ঘোড় সওয়ার হয়ে সেই যুদ্ধস্থলে যান। তাঁর পুলিশ সেনারা পিছু হটলেও নির্ভীক মদনমোহন সে দিন পিছু হটেননি। কিন্তু শেষপর্যন্ত আদালতে প্রমাণের অভাবে অসত্য রক্ষা পেল। ম্যাজিস্ট্রেট মদনমোহন ব্যথিত হৃদয়ে বলেছিলেন— ‘‘আজ আমার অর্দ্ধ মৃত্যু হইল।’’
বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রেও মদনমোহনের মধ্যস্থতায় শ্রীশচন্দ্র ও কালীমতির বিয়ে হয় ৭ ডিসেম্বর, ১৮৫৬ সালে। এটাই ছিল বাংলার প্রথম বিধবা বিবাহ। যদিও ওই দিন ভারত সরকার মদনমোহনের ছুটি মঞ্জুর করেননি বলে তিনি বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় উপস্থিত থেকে বিয়ের কার্যসম্পন্ন করেন।
এর পর অভিন্ন হৃদয় দুই বন্ধুর ভাগ্যে পুরস্কার তো জুটলই না। বরং জুটল তিরস্কার। বিল্বগ্রামের পণ্ডিতসমাজ মদনমোহনকে সমাজচ্যুত করে। আর নিজ গ্রামে অকথ্য গালাগাল ও ইট-পাটকেল খেতে হয়েছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়কেও। সংস্কৃত প্রেসকে কেন্দ্র করে তাঁদের বন্ধুবন্ধনে কিছুটা ছেদ ঘটলেও হৃদয়ের ভালবাসায় কখনও ঘাটতি হয়নি। বন্ধুর প্রতি তেমন বিশ্বাস ছিল বলেই স্বল্পায়ু মদনমোহন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তাঁর ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে বলেছিলেন—‘‘তুমি কেঁদো না, তোমার চিরসহচর তোমায় ফেলিয়া পলায়ন করিতেছে বটে কিন্তু তাহার প্রাণসখা ঈশ্বর তোমায় সেই নিরাশ্রয় অবস্থায় আশ্রয় দিবে। তাহার জীবদ্দশায় তুমি ও আমার প্রাণসমা কন্যাগণ কোন কষ্ট পাইবে না।’’
বিদ্যাসাগরও বন্ধুর সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিলেন। ১৮৫৮ সাল, ৯ মার্চ কলেরা রোগাক্রান্ত হয়ে মুর্শিদাবাদের কান্দিতে পরলোক গমন করেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার।
উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অগ্রগণ্য এই মনীষী বিদ্যাসাগরের যশোভাগ্যের আড়ালে উপেক্ষিত হয়েই রয়ে গেলেন।
জন্মের দু’শো বছর পেরিয়ে এসেছেন মদনমোহন। জন্ম দ্বিশতবর্ষ পার করলেন বিদ্যাসাগরও। আলো পেয়েছেন বীরসিংহের ঈশ্বর। অথচ, নীরবে নেপথ্যেই রইলেন বিল্বগ্রামের মদনমোহন।
লেখক নেতাজি বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক