অর্থমন্ত্রী জানাইয়াছিলেন, বহুবিধ কৃষি-উৎপাদনকে অত্যাবশ্যক পণ্যের তালিকামুক্ত করা হইবে। সেই মর্মে অধ্যাদেশও জারি হইল। অতঃপর চাল, ডাল, আলু বা তৈলবীজের ন্যায় কৃষিজাত পণ্যের উপর রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকিবে না। কৃষককে রাজ্যের গণ্ডির মধ্যেই ফসল বেচিতে বাধ্য করা যাইবে না, ফসলের মূল্যও নিয়ন্ত্রণ করা চলিবে না। এপিএমসি আইন সংস্কারের ফলে এখন যে কেহ কৃষকের নিকট সরাসরি ফসল কিনিতে পারিবেন। চুক্তিচাষের ছাড়পত্রও মিলিয়াছে। জোরালো সংস্কারপ্রচেষ্টা, তাহাতে সংশয় নাই। কৃষকের নিকট গোটা দেশের বাজার উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া হইলে তাঁহার লাভযোগ্যতা বাড়িবে, আশা করা যায়। তবে প্রশ্ন: অত্যাবশ্যক পণ্য তালিকা হইতে কৃষিপণ্যগুলিকে সরাইয়া লওয়া কি রাজ্যের অধিকারে, ফলত দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, হস্তক্ষেপ নহে? ইহা অনস্বীকার্য যে কৃষিপণ্যের অভাব এখন অতীতের স্মৃতিমাত্র— ফলে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনও ফুরাইয়াছে। কিন্তু, বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার যে অধিকারটি হাতে রাখিবার কথা জানাইয়াছে, তাহা অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের হইতে কাড়িয়া লওয়া কেন? কৃষিক্ষেত্রের এই সংস্কারগুলি যতই গুরুত্বপূর্ণ হউক, সেগুলিকে এখনই সারিয়া ফেলিতে হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। সংসদ ফের বসিলে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের কাজটি করাই বিধেয় ছিল, অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে নহে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনেকগুলি পদক্ষেপের মতো এই ক্ষেত্রেও অতি-কেন্দ্রীকরণের সাধনা আছে, বিরোধী নেতাদের এই অভিযোগ অসার নহে।
অর্থনৈতিক দিক দিয়া, কৃষির এই সংস্কার কৃষকের পক্ষে লাভজনক হইবার কথা। কিন্তু, তাহার জন্য কিছু পূর্বশর্ত পালনীয়। শুরুতেই একটি গোড়ার প্রশ্ন: কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না কেন? শুধুই অত্যবাশ্যক পণ্য আইনের কারণে? শুধুই এপিএমসি লাইসেন্সি ব্যতীত কাহাকে পণ্য বিক্রয় করা চলিবে না, এই ফরমানে? উত্তর জানাইবে: না, কৃষকের মূল সমস্যা, ফসল উৎপাদনের পর তাহা ধরিয়া রাখিতে না পারা। কৃষক তাঁহার ফসল উঠিবার পরই— এমনকি, কখনও কখনও ফসল উঠিবার পূর্বেই— তাহা বেচিয়া দিতে বাধ্য হন দুইটি কারণে। এক, তাঁহাকে মহাজনের দেনা চুকাইতে হইবে; দুই, বাজারে দাম চড়া অবধি অপেক্ষা করিতে হইলে যে ভাবে ফসল মজুত করিতে হয়, তাঁহার সেই উপায় নাই। বাজারে দর যথেষ্ট চড়া অবধি অপেক্ষা না করিতে পারিলে লাভের আশা ক্ষীণ। ফলে, এই দুইটি সমস্যার সমাধান না করিতে পারিলে কৃষকের জন্য দেশের বাজারের দরজা খুলিয়া দেওয়া-না দেওয়া সমান— কারণ, বাজারে দাম বাড়িবার অপেক্ষা করা তাঁহার সাধ্যের অতীত হইবে।
অর্থাৎ, কৃষকের নিকট বর্তমান সংস্কারকে সত্যই লাভজনক করিয়া তুলিতে হইলে তাঁহাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুলভ করিতে হইবে। সরকার খাতায়-কলমে ঋণের ব্যবস্থা করে; কিন্তু হিসাব বলিতেছে, সেই টাকা অতিবৃহৎ বা বৃহৎ কৃষকের স্তর পার হইয়া প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, এমনকি মাঝারি কৃষকের হাতেও পৌঁছায় না। ভাগচাষিদের অবস্থা বলাই বাহুল্য। এখনও অধিকাংশ কৃষক মহাজনের উপর নির্ভরশীল। অনেকেই এই চুক্তিতে টাকা ধার করেন যে উৎপন্ন ফসলের সিংহভাগ মহাজনই লইবেন। তাঁহাদের হাতে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করা বিধেয়। আর প্রয়োজন ফার্মগেট পরিকাঠামোর। হিমঘর ইত্যাদিকে কৃষকের নাগালে আনিতে হইবে। তাহার জন্য ব্লকস্তরে বিস্তারিত পরিকাঠামো নির্মাণ করিতে হইবে। সুলভ পরিবহণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। কৃষি সংস্কারের যে অভিমুখে সরকার চলিতে চাহে, তাহাকে যদি অর্থপূর্ণ করিয়া তুলিতে হয়, তবে এই গোড়ার কথাগুলি বিস্মৃত হইলে চলিবে না।