শিকার উৎসবে মারা হয়েছে জঙ্গলের ময়ূর। ছবি: সুজিত মাহাতো
প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টরের বেশি দুর্গম, ঘন, পাহাড়ি বনাঞ্চল দিয়ে ঘেরা অযোধ্যা পাহাড়। একটা সময়ে এই জঙ্গল ছিল বিভিন্ন বন্য পশুর নিরাপদ আবাস। ভালুক, নেকড়ে, হায়না, শুয়োর, হরিণ, নানা রকমের পাখি...আরও কত কী! সতেরো-আঠারো বছর আগেও বুনো ভালুকেরা পাহাড় লাগোয়া শিরকাবাদ গ্রামের আখবাগানে প্রায়ই হানা দিত। মনের সুখে আখ খেয়ে ভোরের আগেই ঢুকে পড়ত গভীর অযোধ্যার জঙ্গলে। এখন আর সে দিন নেই। বুনো ভালুক, হায়না, গাধা বাঘ...ওরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
বহু আগে থেকেই যদিও এই সব বন্যপ্রাণদের ধ্বংস করার কাজ শুরু হয়েছিল। এক সময়ে আনন্দের খোরাক হিসেবে ‘শিকার উৎসব’ হত। বনের ভেতর ফাঁকা জায়গায় তাঁবু ফেলে বিভিন্ন জায়গা থেকে শিকারের জন্য শিকারিরা জড়ো হতেন। জমিদারের লোকজনের পাশাপাশি দক্ষ শিকারি, স্থানীয় যুবকেরাও থাকতেন। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নানা বিকট শব্দ করে বন্য জন্তুদের ভয় দেখিয়ে শিকার করতেন তাঁরা। চলত নাচ-গান আর শিকার করে আনা বুনো জন্তুদের মাংস সহযোগে মদ-হাঁড়িয়া। ফাগুন থেকে জ্যৈষ্ঠ—এই চার মাসের নির্দিষ্ট কোনও দিনে, পূজা-পার্বণ বা লোকাচারকে কেন্দ্র করেই এই শিকার উৎসব পালিত হত।
তখন বন্যজন্তুর শিকার বেআইনি ছিল না। বরং বুনো হাতি, বাঘ, নেকড়ে, শুয়োর, হরিণ বা এই ধরনের জন্তুর শিকারের জন্য শিকারিদের ডেকে পাঠানো হত। তখন এদের সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়নি। কারণ, শিকার ছিল নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় আর এদের বেঁচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশও বজায় ছিল।
দিন বদলেছে। সেই জমিদারেরা আর নেই। প্রাণী হত্যা রুখতে তৈরি হয়েছে বন্যপ্রাণ আইন, ১৯৭২। পরে বনভূমির সংকোচন রুখতে তৈরি হয়েছে বন সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০। তবু অযোধ্যা পাহাড় দিন-দিন শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। এখনও পড়শি রাজ্য-সহ দূর-দূরান্ত থেকে নানা বয়সের কয়েক হাজার মানুষ অযোধ্যা পাহাড়ের দুর্গম জঙ্গলে বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে শিকার উৎসবে মেতে ওঠেন। এখনও নানা উৎসব, লোকাচারকে কেন্দ্র করে পুরুলিয়ায় বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষেরা তির, ধনুক, বল্লম নিয়ে গভীর বনে বুনো জন্তু শিকার করেন। ফি বছরই শিকারির হাতে মারা যায় নানা প্রজাতির বুনো জন্তুরা। পাশাপাশি, বন ধ্বংস করে তৈরি হচ্ছে পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ প্রকল্পের নানান কাঠামো।
ফি বছরে বন দফতর-সহ নানা সরকারি-বেসরকারি সংস্থা শিকার রুখতে নানা সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে আয়োজন করে। চলে নানা প্রচারও। শিকার রুখতে চলে বনকর্মীদের টহলও। তবু শিকারে যথেষ্ট লাগাম পড়ছে কি? উৎসবের নামে সকলের চোখের সামনে বুনো জন্তুদের হত্যা করা হয়। অনেকেরই অভিযোগ, নিচুতলার বনকর্মীদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে এমন ক্ষমতা নেই যে দলবদ্ধ শিকারীদের বাধা দেয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখন অনুরোধ করে শিকার বন্ধের চেষ্টা চলছে। দু’একটি ক্ষেত্রে তাতে কাজও হচ্ছে বলে শোনা যায়।
ফাগুন থেকে জ্যৈষ্ঠ, প্রায় চার মাস নির্দিষ্ট দিনগুলিতে শিকারের দামামা বেজে ওঠে। ছোট-বড় নানা বুনো জন্তুদের শিকারির হাতে প্রাণ যাবে সেই সময়। প্রশাসনের কর্তারা হিসেব কষবেন, কত শিকারি এ বার এল আর কত রকমের কী কী বন্যপ্রাণী হত্যা হল। তার পরিসংখ্যান তৈরিতে ব্যস্ত থাকবেন। নানা গণ-মাধ্যম চেষ্টা করবে শিকারের নানা খবর পরিবেশন করতে। দোষ-ত্রুটি ধরতে এর দায় কার, এই নিয়ে শুরু হবে চাপানউতোরও। যাঁরা শিকার করেন না বা বন্যপ্রাণী তথা পরিবেশ রক্ষায় সরব, তাঁরা কিছু দিন প্রতিবাদ করে তাঁদের ক্ষোভকে ব্যক্ত করবেন। ঠান্ডা ঘরে বসে কিছু পরিকল্পনা হয়ত হবে। আবার, ‘আসছে বছর আবার হবে’ বলে শিকারিরা সমস্বরে সুর মেলাবে। ধীরে ধীরে বাকি সব বুনো জন্তু, গভীর বন হারিয়ে যাবে চিরতরে।
তবে এটাও ঠিক, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বন্যপ্রাণীদের সংখ্যা বেশ কমে যাওয়া ও লাগাতার সচেতনতার প্রচারে শিকার উৎসবে মানুষের সমাগম কমেছে। যদিও এ আমাদের সাফল্য না বুনো জন্তু কমে যাওয়ার ফল, তা বলা মুশকিল।
লেখক প্রাক্তন বন আধিকারিক