জঙ্গলে ফেরা হল না। ফের ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু একটি বাইসনের মৃত্যু হল। ২২ জুলাই কোচবিহারের একটি গ্রামের ঘটনা। উত্তরবঙ্গে এমন ঘটনার উদাহরণ অবশ্যই নতুন নয়। জলঢাকা নদীতে পড়ে ছিল একটি হাতির দেহ। ময়নাতদন্তের পরে বোঝা গিয়েছে, তার পেটে ছিল প্লাস্টিকে মোড়া কীটনাশক। শুধু তাই নয়, জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বুনোদের মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলছে, এমন অভিযোগও উঠেছে নানা সময়ে। কিন্তু আর কত দিন? কিন্তু কেন লোকালয়ে ঢুকে পড়ার খেসারত জীবন দিয়ে মেটাতে হবে বন্যপ্রাণীদের?
পরিবেশপ্রেমীদের অনেকেই এ ভাবে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন। কিন্তু সে কথা প্রথম প্রথম সবাই গুরুত্ব দিয়ে ভাবলেও কিছু দিন পরে নানা কথার মধ্যে আবার সেই উদ্বেগ ডুবে যায়। দেশে-রাজ্যে নানা ঘটনা ঘটছে, তাতে বনের প্রাণীদের জন্য কতটুকু জায়গা বরাদ্দ করতে পারে সংবাদ মাধ্যমও?
কিন্তু এই সমস্যা এমনই একটি সমস্যা, খাপছাড়া ভাবে ভাবলে যার সমাধান হবে না। দরকার নির্দিষ্ট চিন্তা, সেই মতো পরিকল্পনা এবং তার যথাযথ রূপায়ণ।
শুরুতেই ভাবতে হবে জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে কেন বেরিয়ে আসছে বুনোরা? কখনও বাইসন, কখনও হাতি, কখনও আবার চিতাবাঘ ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। লোকালয়ে হরিণ ঢুকে পড়ার নজিরও অনেকেরই বেশ জানা। কিন্তু ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু বাইসনের মৃত্যুর ঘটনা অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি বলে অভিযোগ। তাই ওই মৃত্যুতে ফের প্রশ্ন উঠছে।
বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বাইসনের জঙ্গল ছেড়ে বেরোনোর প্রবণতার পিছনে অনেক কারণই রয়েছে। যেমন, জঙ্গলে স্থান সঙ্কুলান এবং জল ও খাবারের অভাব। আবার গরমের মরসুমে ভুট্টার টানে বাইসন বেরোতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন। রোদের তাপে জঙ্গলে ঘাস শুকিয়ে যাওয়া, গাছপালা ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় খাবারে টান পড়ে। শুখা মরসুমে জঙ্গলের গাছের শুকনো পাতায় সচেতন ভাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আশঙ্কার কথাও বলেন অনেকে। বাইসনের ক্ষেত্রে উদাসীনতার অভিযোগ আরও বেশি। উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়া, চিলাপাতা, গরুমারা, চাপরামারির মতো নানা জঙ্গলে বাইসনের সংখ্যা কত সে সব নিয়ে কোন সুমারি এত দিনেও হয়নি। ফলে কোন এলাকায় মাদি ও পুরুষ বাইসনের সংখ্যার আনুপাতিক হার কেমন সেটাও স্পষ্ট নয়। এ সব নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। কারণ উত্তরবঙ্গের নানা এলাকায় বাইসনের আনাগোনার ঘটনা প্রায় ফি বছরের রুটিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পচ্ছন্দের সঙ্গিনী দখল নিয়ে বন্যপ্রাণী জগতে নিজেদের লড়াইয়ের আশঙ্কা তো থাকেই। সেই লড়াইয়ে হেরে গিয়ে কোনও বাইসন দূরে চলে যেতে গিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
কিন্তু তার চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হল, ঘুমপাড়ানি গুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতনতা আদৌ নেওয়া হচ্ছে তো? ঘুমপাড়ানিতে গুলিতে কাবু বাইসনই ‘বেশিরভাগ’ ক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে, এমন অভিযোগ রয়েছে? বাইসনের বয়স, লিঙ্গ দেখে যে মাত্রার ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করা উচিত, তার থেকে বেশি কি ব্যবহৃত হচ্ছে?
এই তত্ত্ব অবশ্য বনকর্তারা অনেকে মানতে নারাজ। কিন্তু বন দফতরের অনেক কর্মীই জানান, অনেক সময় বাইসন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে দাপাদাপি শুরু করলে স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে পড়ে বন দফতর ঘুমপাড়ানি গুলি ছোড়ে। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। বন লাগোয়া এলাকায় যাঁরা থাকতে শুরু করেছেন, তাঁদের রক্ষা করার দায়িত্ব নিশ্চয় প্রশাসনের থাকছে। কিন্তু তাঁরা বেআইনি ভাবে রয়েছেন কি না, তা-ও দেখার কথা। সব চেয়ে বড় কথা, বন্যপ্রাণীরও যে বাঁচার অধিকার রয়েছে, সে কথা সবাইকে বুঝতে হবে। যে সব এলাকায় বন্যপ্রাণীর করিডরে মানুষ বসবাস শুরু করেছেন, সেখানে বন দফতরের নজরদারি কেন কড়া নয়, সে প্রশ্নও উঠছে। (শেষাংশ আগামিকাল)
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)