আজকের দিনে সংস্কৃত ভাষা ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হল না কেন— এই বিষয় বহু বিতর্ক হয়েছে। নানা প্রশ্নের ভিড় উঠে আসে। পাণিনির অবিস্মরণীয় প্রয়াসে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ লিখেছিলেন। ভাষা হয়েছিল ততোধিক সমৃদ্ধ। পতঞ্জলিও তাঁর মহাভাষ্যে এই কথাই বলে গিয়েছেন যে, সংস্কৃত ভাষাকে সুবিন্যস্ত করে তোলাই ছিল পাণিনীয় ব্যাকরণের কাজ। উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়, ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক বাহকগণ, মুনি-ঋষি-পুরোহিতবর্গ সংস্কৃত ভাষাতেই ভাবপ্রকাশ করতেন। কিন্তু কথ্য ভাষায় নানা পরিবর্তন এসেছে। সংস্কৃত ভাষাতেও বহু আঞ্চলিক শব্দের প্রভাব পড়ে ভাষার রূপকে বদলেছে।
আসলে বাস্তব সমাজের নিরিখে বলা যেতে পারে, ভাষা পরিবর্তনশীল। মানুষের কথনভঙ্গি ও শ্রবণ ক্ষমতার মধ্য দিয়েই ভাষার নিয়ত বিবর্তনের ধারা বয়ে চলে। আমরা দুঃখ, বেদনা, চাহিদা, উচ্ছ্বাস ইত্যাদির প্রকাশ যখন করি তখন চেষ্টা করি তা সহজ থেকে সহজতর করে উপস্থাপনা করতে। কারণ তার ফলে যেমন বক্তার সহজ প্রকাশ হয়, তেমন গ্রহীতার সহজবোধ্য গ্রহণ সম্ভব। আর এই ভাষার মাধ্যমেই অনাবিল হয়ে ওঠে মানুষের পরস্পরের মেলবন্ধন। সহজতর ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে জীবনপ্রণালী।
ইতিহাস বলে শুরুতে আদিম যুগে ভাবপ্রকাশের মাধ্যম ছিল কিছু দুর্বোধ্য শব্দ। কালান্তরে তা অর্থবহ শব্দে পরিণত হয়েছে। আমাদের আদিভাষা ছিল সংস্কৃত। যার শব্দভাণ্ডার ভাষার জগতে অপরিমিত। যার শ্রুতিমাধুর্যও ততোধিক। আমরা তাকে ‘দেবভাষা’ বলে থাকি। এত ব্যাপকতা যে ভাষার শব্দভাণ্ডারে তাকে আজ আবার কেন মৃতভাষা বলি। কিন্তু কেন এই পরিণতি?
একটা সময়ের বহুল প্রচলিত এই ভাষা, যাতে এত সাহিত্য রচিত হয়েছে, যাতে প্রথম গ্রন্থ বেদ রচিত, যা ছিল রাজারাজরার কথ্য ভাষা, তা আজ অচলপ্রায় কেনই বা হল? যদিও বা শতাধিক চতুষ্পাঠী, বৈদিক বিদ্যালয় আজও আছে। কলেজ বা ইউনিভার্সিটিগুলোতে আজও সংস্কৃত অনার্স পড়নো হয়, দক্ষিণের কিছু ঘরে আজও কথিত হয় এই ভাষা, তবুও তা হয়তো অন্য ভাষার জনপ্রিয়তার সঙ্গে গণনায় আসে না। কারণ সাধারণের কাছে তা দুর্বোধ্য। শতাধিক মানুষ পঠন-পাঠন বা শিক্ষণে নিযুক্ত থাকলেও আমরা আমাদের আদি ভাষাকে ধরে রাখতে পারিনি। সংস্কৃত ভাষাবিদদের একমাত্র জীবিকা আজ শিক্ষকতা। বাকি কোনও শাখায় এই ভাষার প্রচলন নেই কেন, এই প্রশ্নের উত্তর কই?
ভাষাবিদদের হাজারো সমীক্ষা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় আর্যভাষাকে তাঁরা তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। ১) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা, যার চলন ছিল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব, যা হল বৈদিক সংস্কৃত ভাষা, ২) মধ্যভারতীয় আর্যভাষা যার প্রচলন ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব। এরই প্রভাব ছিল প্রাকৃত ও পালি ভাষা এবং লৌকিক সংস্কৃতভাষায়, এবং ৩) নব্যভারতীয় আর্যভাষা যা ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে প্রচলিত, এর প্রভাবেই পড়ে পঞ্জাবি, মরাঠি, বাংলা, হিন্দি ইত্যাদি। রামেশ্বর শ এক আলোচনায় বলেছেন, আর্যরা দুই দলে ভারতবর্ষে এসেছিল। প্রথম দলটি দ্বিতীয় দলের আক্রমণে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের ভাষাকে বহিরঙ্গ ভাষা ও যে দলটি ভারতবর্ষের কেন্দ্রে বসবাস করেছিল, তাদের ভাষাকে অন্তরঙ্গ ভাষা বলা হয়েছিল। সেই অন্তরঙ্গ ভাষাগুলি হল, পঞ্জাবি, হিন্দি। আর বহিরঙ্গের মধ্যে কাশ্মীরি, বাংলা, ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষা পরিগণিত হয়েছে।
সংস্কৃত যখন প্রচলিত ভাষা ছিল তার দু’টো ভেদ ছিল—বৈদিক ও লৌকিক সংস্কৃত। কিন্তু সেই সময় জনসাধারণের ভাষা কী ছিল? আমরা আবার এই ভাষার দু’টি দিক দেখতে পাই। একটি শাস্ত্রীয়, আর একটি কথিত। সাহিত্যের ভাষা অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে গৃহীত হলেও কথ্য সংস্কৃতর রূপ জনসমাজ সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। যে ভাবে পরবর্তীতে পালি বা প্রাকৃতকে গ্রহণ করেছিল। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সংস্কৃতের ব্যাকরণ। যদিও আমরা ব্যাকরণ শিখে কথা বলি না। তবুও কথ্য প্রক্রিয়াতেও ব্যাকরণ যুক্তই থাকে। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রয়োগ কিছুটা ভিন্ন। বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া ইত্যাদির বহুবিধতাকে এখানে ক্লিষ্টই মনে হয়। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যে প্রয়োগ আমরা দেখি তা এই রকম— রাম যাচ্ছে, রাম ও সীতা যাচ্ছে, রামেরা সকলে যাচ্ছে। এখানে প্রতিটা বচনের ক্ষেত্রে ক্রিয়া হল ‘যাচ্ছে’। কিন্তু সংস্কৃতে এই বাক্যবিন্যাসই অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এখানে ‘রাম যাচ্ছে’ ‘রামঃ গচ্ছতি’, ‘রাম ও সীতা যাচ্ছে’ ‘রামঃ সীতা চ গচ্ছতঃ’, ‘বালকেরা যাচ্ছে’ ‘বালকাঃ গচ্ছন্তি’ এই রূপ প্রয়োগ হয়। এ তো গেল সামান্য উদাহরণ। এ ভাবে ‘যাচ্ছে’ শব্দটিরই প্রতিটি লিঙ্গ, বচন, পুরুষ ও কাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ হয়ে থাকে। এর পরেও আছে অজস্র অ-কারান্ত, আ-কারান্ত, ই-কারান্ত, ঈ-কারান্ত, ব্যঞ্জনান্ত, সংখ্যাবাচক ইত্যাদি শব্দের ভিড়।
আবার বাংলায় তিনটে কালের ব্যবহারে মানুষ নিজের সমস্ত ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম। কিন্তু সংস্কৃততে কালের রূপ আবার দশটি। এই দশটি কাল অনুযায়ী ক্রিয়ার আবার ভিন্ন ভিন্ন রূপ হয়। সুতরাং মানুষকে যদি একটি বাক্যে অন্তরের ভাব প্রকাশ করতে হয় তো তাকে এত শব্দের প্রকারভেদ মনে রাখতে হবে, তার প্রয়োগ কৌশল জানতে হবে, বাক্যবিন্যাস নিয়ে ভাবতে হবে। তখন সাবলীল ভাবে ভাবপ্রকাশে অন্তরায় হয়ে উঠবে এই ব্যাকরণের জটিলতা। সেহেতু মানুষ উচ্চারণ মাত্রই সে নিজের ভাব প্রকাশ করতে পারে যাতে সেই পথকেই সে বেছে নেবে। সহজ বাংলা ভাষাকেই মানুষ গ্রহণ করেছে সে কারণেই। প্রতিটা বাক্য প্রকাশে যদি ভাবতে বসতে হয় শব্দ পিছু ক্রিয়া, লিঙ্গ, কাল, বচন ইত্যাদি সঠিক ব্যবহার করছি তো? তবে কথা বলার আগ্রহই হয়তো হারাব আমরা।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বিবর্তনের পথে প্রচুর বর্ণবিপর্যয়, বর্ণলোপ, অপভ্রংশ ইত্যাদি হয়েছে। বিভিন্ন বিদেশি ভাষার প্রভাবকেও বাংলা ভাষার মধ্যে গ্রহণ করে নিয়েছে মানুষ উচ্চারণের সুবিধার্থেই। ৯ কার ও ঋ কার যেমন বহু পূর্বেই লোপ পেয়েছিল। যেমন ‘মৃগ’ শব্দ থেকে মিগ, মুগ, ম্রিগ, ম্রুগ হয়েছে। ‘ঋষি’ শব্দ ইসি বা রিসি হয়েছে। পদের শেষে থাকা বিসর্গ লুপ্ত হয়েছে, জনঃ শব্দ হয়েছে জন বা জনো। পদের শুরুতে বসা ব্যঞ্জনবর্ণ লুপ্ত হয়েছে কখনও, ‘ত্রীনি’ উচ্চারিত হয়েছে ‘তিন্নি’। ভাষার এই বিবর্তনের অজস্র উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন, নৃত্য > নচ্চ> নাচ, হস্ত >হত্ত> হাথ>হাত, কণ্টক>কাঁটা, পঞ্চ>পাঁচ, ঘৃত>ঘিঅ>ঘি, বধু>বউ, মধু>মৌ।
কিন্তু বাংলা ভাষার একটা স্বকীয়তা আছে। সংস্কৃতর শব্দ সম্পদকে নানা ভাবেই প্রাচীন পণ্ডিতরা গ্রহণ করেছেন বাংলায়, বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছেন কিন্তু নিজস্বতা অটুট রেখেছেন। কথ্য ভাষাতেও আমরা বহু শব্দের প্রয়োগকে রেখেছি কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের কাঠিন্যকে ত্যাগ করেছি। ‘সংস্কৃত ব্যকরণ ও ভাষা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে করুণাসিন্ধু দাস মহাশয় খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ধ্বনিশৃঙ্খলা নির্ভর শব্দালঙ্কার এখানে মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে কর্ণেষু বমতি মধুধারাম্। যেমন, তুষারা ভান্তি শুভ্রাঃ, বিশালাঃ শিলাঃ, দিবসঃ প্রখরাতপঃ তপ্তো বায়ুর্ভাতি ইত্যাদি। ক্রিয়াপদ আগে বা পরে লিখে কিংবা বাদ দিয়ে বাক্ সুষমা সম্পাদনের যে পথ দেখিয়েছিলেন সংস্কৃত শিক্ষায়, ‘বনে থাকে বাঘ। গাছে থাকে পাখি। জলে থাকে মাছ। ডালে আছে ফল।... বাঘ আছে আমবনে। গায়ে চাকা চাকা দাগ। ...ডালে ডালে কাক ডাকে। খালে বক মাছ ধরে।... এই খানে মৌ-চাক। তাতে আছে মধু ভরা।’—এমনই করে সহজপাঠে তা মাধুর্যমণ্ডিত
পূর্ণরূপ পায়।’’