এসপার-ওসপারে এত অনীহা কেন?

সেখানে এই রহস্য-রোমাঞ্চ সুখকর বা উপভোগ্য নয়, বরং কুনাট্যের সমার্থক।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯ ০০:৩০
Share:

—ফাইল চিত্র।

রাজনীতির এক অনর্থক এবং দুর্বোধ্য কুনাট্যরঙ্গ চলছে তো চলছেই। সব্যসাচী দত্তর সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের টানাপড়েন যেন রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা টেলিভিশন ধারাবাহিককে হার মানিয়ে দেবে। গল্পে, উপন্যাসে, টেলিভিশনে বা কল্পকথায় এই রহস্য-রোমাঞ্চ কারও ভাল লাগতেই পারে। কিন্তু রাজনীতি তো রহস্য বা রোমাঞ্চ তৈরি করার ক্ষেত্র নয়! রাজনীতি হল জনসেবার ক্ষেত্র, সুসংহতভাবে রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তটাকে পরিচালনা করার ক্ষেত্র। সেখানে এই রহস্য-রোমাঞ্চ সুখকর বা উপভোগ্য নয়, বরং কুনাট্যের সমার্থক।

Advertisement

সব্যসাচী দত্ত বিধানগর পুরনিগমের মেয়র এবং রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক। দুটি পদেই তিনি নির্বাচিত হয়েছেন তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে। অতএব নৈতিকতা বলে, এই সব পদে থাকতে হলে সব্যসাচী দত্তকে তৃণমূলের প্রতি অনুগত থাকতে হবে। তবে অন্যথাও ঘটে এবং আমাদের গণতন্ত্রে সেই অন্যথা ঘটানোর অবকাশও রয়েছে। সব্যসাচী দত্ত তৃণমূল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বলে কখনও তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবেন না বা অন্য কোনও দলে যেতে পারবেন না, এমন নয়। এমনকি যে বিধাননগর পুরনিগমের তিনি মেয়র, সেখানকার নির্দিষ্ট সংখ্যক কাউন্সিলর তাঁর সঙ্গে দল বদল করতে প্রস্তুত থাকলে পদে বহাল থেকেই বৈধ ভাবে সব্যসাচী তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবেন, এমন সংস্থানও রয়েছে।

আবার তৃণমূলও চাইলে সব্যসাচী দত্তর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতেই পারে। তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড অথবা বহিষ্কার করতেই পারেন। তার পরে অথবা তার আগেই সব্যসাচীকে মেয়র পদ থেকে তৃণমূল সরিয়ে দিতে পারে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায়।

Advertisement

ম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

কিন্তু দিনের পর দিন দু’পক্ষই টানাপড়েনটা বহাল রেখে চলেছে। সব্যসাচী বারবার দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন, নেতৃত্বকে কটাক্ষ করছেন, অথচ দল ছাড়ছেন না। তৃণমূলও সব্যসাচীকে কখনও কঠোর বার্তা দিচ্ছে, কখনও সতর্ক করছে, কখনও তাঁকে ছাড়াই অন্য কাউন্সিলরদের বৈঠকে ডাকছে, অথচ সাসপেন্ড বা বহিষ্কারের পথে হাঁটছে না। এটা কোন ধরনের রাজনীতি? এটা কী ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি? সব্যসাচী দত্ত যদি মনে করেন, তৃণমূলে তিনি আর থাকতে চান না, তাহলে তিনি তাঁর হাতে থাকা পদগুলিতে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূল ছেড়ে দিতেই পারেন। আর যদি তিনি মনে করেন, মেয়র পদে ইস্তফা না দিয়েই তিনি দলত্যাগ বা দলবদল করতে পারবেন, যদি তিনি মনে করেন দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর না হতে দেওয়ার মতো সংখ্যা তাঁর সঙ্গে রয়েছে, তাহলে তিনি সে পথেও হাঁটতেই পারেন। কিন্তু সব্যসাচী কোনওটাই করছেন না। উল্টোদিকে তৃণমূলও দীর্ঘদিন ধরে সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রেখেছে। হয় সব্যসাচীর যাবতীয় বক্তব্য মেনে নিন অথবা অবজ্ঞা করুন। না হলে সব্যসাচীকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দল থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা করুন। এই দুটো পথের যে কোনও একটাই তো তৃণমূল নেতৃত্বকে বেছে নিতে হবে। কিন্তু এই দুটোর মধ্যে কোনও পথেই তৃণমূল হাঁটতে চাইছে না।

আরও পড়ুন: অনাস্থাই আনা হচ্ছে, জানিয়ে দিল তৃণমূল, দেখতে থাকুন কী হয়, মন্তব্য সব্যসাচীর

অবস্থান স্পষ্ট করায় অথবা টানাপড়েনটার দ্রুত অবসান ঘটানোয় সব পক্ষেরই এত অনীহা কেন, বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। দল ছাড়তে কি সব্যসাচী দত্ত ভয় পাচ্ছেন? দলের এবং নেতৃত্বের নিরন্তর সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন, অথচ দল ছাড়ছেন না, এটা কেন হচ্ছে? উল্টো দিকে তৃণমূল কি সব্যসাচী দত্তকে বহিষ্কার করতে ভীত? সব্যসাচীর বক্তব্যগুলোকে দল অনুমোদন করছে না অথচ তাঁকে দল থেকেও তাড়াচ্ছে না, এমনটাই বা কেন ঘটছে?

অবশেষে বিধাননগর পুরনিগমে সব্যসাচী দত্তর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার প্রক্রিয়া তৃণমূল শুরু করল। অধিকাংশ কাউন্সিলর কার পক্ষে, স্পষ্ট হয়ে যাবে অনাস্থা প্রস্তাবের উপরে ভোটাভুটি হলেই। ভোটাভুটিতে সব্যসাচীর পদ যেতে পারে, আবার তৃণমূলেরও মুখ পুড়তে পারে। এ কথা সবারই জানা। রাজনীতিতে এই দু’রকম সম্ভাবনাই কাজ করে। সেই সম্ভাবনাময় বাস্তবটাকেই কি সবাই ভয় পাচ্ছিলেন? সেই কারণেই কি দিনের পর দিন ধোঁয়াশা বহাল রাখা হচ্ছিল? রাজনীতিকদের মধ্যে যে পারস্পরিক ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তাতে ধোঁয়াশা থাকবে, না অস্বচ্ছতা থাকবে, তা নিয়ে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু জনসমক্ষে নিজেদের মুখ বাঁচানোর তাগিদে সাধারণ নাগরিককে বিভ্রান্তিতে রাখার নীতি নেওয়াটা অবাঞ্ছিত।

রাজনীতির উপর থেকে সাধারণ নাগরিকদের এক বিরাট অংশের আস্থা এমনিতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে রাজার নীতিও আর নেই, নীতির রাজকীয়তাও উধাও। এর পরও যদি এইরকম কুনাট্যরঙ্গকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় দিকে দিকে, তাহলে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে বিপর্যয় তৈরি হবে। সে বিপর্যয় কিন্তু আমাদের জন্য ভাল হবে না। আমাদের দেশে গোটা বন্দোবস্তটাই রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত। সেই রাজনীতির উপর থেকেই যদি সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় নাগরিকের আস্থা বা ভরসা, তাহলে আণাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোটাকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ন্যূনতম স্বচ্ছতাটা তাই অপরিহার্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement