মানুষ, শোনা যায়, নিজেকেই সর্বাধিক ভালবাসে। কেহ বিস্তর, কেহ অল্প। তবে সম্প্রতি ব্রিটেনের দুইটি বিশ্ববিদ্যালেয়র শিক্ষক-গবেষকরা একটি সমীক্ষা চালাইয়া দেখিয়াছেন যে নারী অপেক্ষা পুরুষরা অনেক বেশি আত্মপ্রেমে নিমগ্ন থাকেন। এবং সেই আত্মপ্রেম প্রায়শ অপরের প্রতি আগ্রাসী। ৫০০ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ-মহিলাকে লইয়া কৃত এই সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরুষরা মানুষকে অপমান করিতে এবং নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ দেখাইবার ক্ষেত্রে মহিলাদের অপেক্ষা সংখ্যায় অনেক আগাইয়া রহিয়াছেন। আগ্রাসন প্রদর্শনকে স্ব-অস্ত্র ভাবিতেছেন। নিজেকে সবার উপরে স্থান দিবার জন্য তাঁহারা মরিয়া। অপর দিকে, মহিলারা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করিতেছেন বন্ধুত্ব করিবার জন্য, জ্ঞান সংগ্রহের জন্য কিংবা মানুষের সহিত সংযোগ বাড়াইবার জন্য। সমীক্ষার পরিসংখ্যানগুলির যাথার্থ্য লইয়া সংশয় থাকিতে পারে, কিন্তু প্রতিপাদ্যটি উড়াইয়া দেওয়া কঠিন।
প্রশ্ন উঠিবে, পুরুষ কেন বেশি আগ্রাসী ও আত্মকেন্দ্রিক? এই প্রশ্নের কোনও সর্বজনসম্মত উত্তর নাই। তবে একটি কারণ হইতে পারে যে, সমাজে তাহার পৌরুষ স্বীকৃত, প্রতিষ্ঠিত। তাহাকে সেই প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত পৌরুষকে পদে পদে জাহির করিয়া চলিতে হয়। আগ্রাসন তাহারই পরিণাম। অন্য দিকে, সমাজে স্বমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নারীর লড়াই বহু যুগ ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে এবং চলিবে। সেই লড়াইয়ে অহংকারের উপযোগিতা কম। উপরন্তু পৃথিবী যতই আগাইয়া যাক, এখনও সংসারের অধিকাংশ কাজই নারীকে করিতে হয়। এই সংসারধর্ম পালনের জন্য খানিকটা বাধ্যতায়, খানিকটা স্বেচ্ছায় নারী বিভিন্ন মানুষের সহিত সংযোগ রাখিয়া চলে— সে কাজের লোক হউক বা সন্তানের শিক্ষিকা কিংবা দোকানদার। এই যে বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন মানুষের সহিত ক্রমাগত তাহার স্বাভাবিক যোগাযোগ, ইহা নারীর মননকে— হয়তো জোর করিয়াই— আত্মপ্রেমের সীমা অতিক্রম করিয়া অনেকখানি বিস্তৃত করিয়া দেয়।
অথচ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ তো সামাজিক জীব। তাহা হইলে কেবল পুরুষদের স্কন্ধে নিজেকে প্রমাণ করিবার এতখানি দায় বর্তাইল কেন? তাহার জন্য কেবল পাইকারি ভাবে সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবকে দায়ী করিলে চলিবে না। এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরও সব পুরুষ কি সমান আত্মনিমগ্ন? আগ্রাসী? পিতৃতন্ত্র বৃহৎ সমাজকে অনেকখানি আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে বটে, কিন্তু ইহাও অনস্বীকার্য যে, এই সমাজেও অনেক পুরুষই স্বভাবত আগ্রাসী পৌরুষে আক্রান্ত নহেন। তাহার কারণ হয়তো তাঁহাদের প্রত্যক্ষ প্রতিবেশ। কেবল সামগ্রিক পিতৃতন্ত্র নহে, তাহার সঙ্গে এক জন মানুষ কী পরিবেশে বড় হইয়া উঠিতেছেন, তাহাও তাঁহার স্বভাবের একটি বড় নিয়ন্ত্রক। কেহ যদি তাঁহার পরিবারের বা প্রতিবেশের নেতিবাচক প্রভাবে বড় হন, তবে তাঁহার চরিত্র ও মন গঠনে এই নেতিবাচকতার একটি বিশেষ ভূমিকা থাকিবে। বিদ্যালয়, বাড়ি, খেলার মাঠ— চারিপাশের ছোট্ট গণ্ডিতে যদি আগ্রাসনকে বিয়োগ করিয়া খানিক সহমর্মী কোমলতা যোগ করা যায়, তবে হয়তো কোনও এক ভবিষ্যতে বৃহত্তর সমাজটিও আগ্রাসী আত্মমগ্নতা হইতে মুক্তি পাইবে। সমীক্ষা তখন অন্য পরিসংখ্যান দিবে, আপাতত এইটুকু ভরসা।