গোটা পৃথিবী আজ এই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যে গায়ের রং কালো হওয়া কি অপরাধ?
সুদীর্ঘ দিন ধরে মানবসমাজে বর্ণবিদ্বেষের রাজনীতি চলছে। শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের ঘৃণা করে, ছোট করে, অপমান করে এবং হেয় করে। সাদা চামড়ার মানুষদের এই অমানবিকতা, কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ইতিহাসের লজ্জার বিষয়।
২৫ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পৃথিবীময়। পরে এই মানবসমাজ নানা ভাবে বিভাজিত হয়েছে। কেউ শ্বেতাঙ্গ, কেউ কৃষ্ণাঙ্গ, কারও গায়ের রং হলুদ। পৃথিবী জুড়ে নানা বর্ণের মানুষের বসবাস। শ্বেতাঙ্গরা এতই আধিপত্য বিস্তার করেছে যে ‘শ্বেতাঙ্গ’ হওয়াটাই চরিতার্থ মনে করে অনেক। তাই প্রসাধনে শ্বেতাঙ্গ হওয়ার (ফেয়ার) আয়োজন এত বেশি। যেন শ্বেতাঙ্গ হলেই সুন্দর হওয়া যায়। এই ভুল ধারণার থেকে মানব সংস্কৃতিকে বার করে আনতে হবে। আমরা আমাদের ভারতের অতীতের দিকে তাকাই। রামায়ণের নায়ক নবদুর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্র। তিনি ছিলেন শ্যামবর্ণ। মহাভারতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব কৃষ্ণ। তিনি কালো। বিশ্বজননী মা কালীকার গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ। তা হলে আমাদের অতীত উত্তরাধিকারে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবল প্রতিপত্তি লক্ষ করেছি।
তবু কেন প্রসাধন দ্রব্যের সঙ্গে ফেয়ার কথাটিকে যুক্ত করা হয়েছিল? শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি কেন কৃষ্ণাঙ্গদের উপর প্রতাপ ছড়াবে? কেন কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করবে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ? গোটা মানবসমাজের কাছে এ এক বেদনাদায়ক, তিক্ত অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন: ক্রিমওলাদের হঠাৎ বোধোদয় হল, ভাল, কিন্তু কালো-বিদ্বেষী মনটা বদলাবে কি!
সমস্ত পৃথিবী আজ এই জিজ্ঞাসাচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যে কৃষ্ণাঙ্গরা কি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে হেয়, ছোট, হীন মানুষ? সমস্ত আমেরিকা আজ উত্তাল। খর প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে মানুষজন। গোটা পৃথিবী আজ এই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যে গায়ের রং কালো হওয়া কি অপরাধ? মানবসমাজে এই যে বর্ণবিভাজন, এটা প্রাকৃতিক কারণে সত্য। আমাদের এই ভারতে আর্যরা এক সময় এসে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। অনার্যদের উপরে তারা নিজেদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বর্ণের আভিজাত্য চাপিয়ে দিয়েছিল। অনার্যরা আর্য সংস্কৃতিকে মেনে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনার্যদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ভোলবার নয়। কেন আমরা অনার্যদের ছোট ও নিচু করব? অনার্যদের যে অতীত ঐতিহ্য তা ভারতের গরিমার একটি শীর্ষবিন্দু। তবু আমরা শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা এতই অধিকৃত যে প্রসাধন দ্রব্যের সঙ্গেও এই শ্বেতাঙ্গ ভাবনা জড়িয়ে যায়। এবং ফেয়ার শব্দটি ওই শ্বেতাঙ্গ উত্তরাধিকার থেকেই আসছে।
সমস্ত আমেরিকা আজ উত্তাল। খর প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে মানুষজন।
এটিকে শ্রেয় মনে করা কি উচিত? যা কৃষ্ণ, যা কালো, যা অনার্য উত্তরাধিকার তা কি অতীত ভারতের সত্য ইতিহাস নয়? আমরা সাধারণ মানুষ এই শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতির কাছে এতটাই অবনমিত যে আমাদের সমস্ত সাজসজ্জা, বিলাস, পরিধানবস্ত্র, প্রসাধনদ্রব্য সকল কিছুর মধ্যে রয়েছে এই শ্বেতাঙ্গ অনুরাগ। কেন তা হবে?
আমাদের এই দেশে শ্বেতাঙ্গদের প্রতি অনুরাগ এক ধরনের আত্মঅবমাননা। কেননা অনার্য ভারত, কৃষ্ণাঙ্গ ভারত আমাদের অতীত ও আমাদের ঐতিহ্য। কবি বলছেন, “কৃষ্ণ কালো, তমাল কালো, তাই তমালে ভালবাসি।” আমাদের সকলের প্রিয় ও প্রণম্য কবি রবীন্দ্রনাথ বলছেন “কালো? তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।” আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে এই কৃষ্ণানুরাগ রয়েছে। এই সত্যটি ভুললে চলবে না। আমাদের এই শ্বেতাঙ্গদের প্রতি দুর্বলতা এক ধরনের হীনমন্যতাজাত বোধ। প্রায় ২০০ বছর ধরে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ জাতি আমাদের উপরে ছড়ি ঘুরিয়েছে। আমরা তাদের কাছে অবনত থেকেছি। গভীর বেদনা বোধ করেছি। তবু শ্বেতাঙ্গস্তুতি করেছি। সেই মানসিকতা থেকেই কন্যাকে শ্বেতাঙ্গ করার বাসনায় সেই সব প্রসাধনদ্রব্য বেছে নিয়েছি যা তাকে শুভ্রতর করে।
আমাদের এই হীনমন্যতাবোধ রক্তের ভিতরে ঢুকে শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত। তাই এই অস্বাভাবিক মানসিকতাকে শিকড় থেকে উৎপাটিত করতে হবে এবং পৃথিবী জুড়ে এই সংবাদ ছড়িয়ে দিতে হবে যে কৃষ্ণবর্ণের আকর্ষণ, শোভা, মহিমা, মায়া কিছুমাত্র কম নয়। আমরা প্রসাধনদ্রব্যের গায়ে ‘ফেয়ার’ শব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমরা মানবসমাজের কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের মহিমা ও মর্যাদাকে উপলব্ধি করব এবং উচ্চারণ করব। মানবসভ্যতার কাছে এই বার্তা স্তরে স্তরে পৌঁছে যাক। আমাদের সচেতন, সুশিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত ও মানবিক হতে হবে। সাদা না কালো সেটা কথা নয়, মানুষ এটাই যেন শেষ কথা হয়।
কন্যাকে শ্বেতাঙ্গ করার বাসনায় সেই সব প্রসাধনদ্রব্য বেছে নিয়েছি যা তাকে শুভ্রতর করে।
আমাদের অবচেতনের গভীরে এই শ্বেতাঙ্গমুগ্ধতা কাজ করে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি যে আকর্ষণ ও ভালবাসা আমাদের থাকা উচিত, তা আমরা সচেতন চেষ্টায় ফিরিয়ে আনব।
‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ থেকে শুধু ‘ফেয়ার’ কথাটিকে তুলে দিলেই চলবে না, সত্যকারের মানবিক বর্ণবিদ্বেষহীন ও দরদী হতে হবে আমাদের। মনের অবচেতনে শ্বেতাঙ্গপ্রীতি বজায় রেখে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সুবিচারের চেষ্টা চলবে না। মনের গভীর থেকে এই শ্বেতাঙ্গঅন্ধতা ও মোহকে তুলে ফেলতে হবে। মানুষের প্রথম ও শেষ পরিচয় সে মানুষ। ফরসা না কালো, শ্বেতাঙ্গ না কৃষ্ণাঙ্গ— তা নয়। এটা একটি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যাপার। মনের গভীর থেকে কৃষ্ণাঙ্গপ্রীতিকে সঞ্চালিত করতে হবে এবং সমস্ত সংস্কৃতিতে, শিল্পে, প্রসাধনে, পোশাকে এই শ্বেতাঙ্গপ্রীতির অন্ধকারকে বর্জন করতে হবে।
শ্বেতাঙ্গপ্রীতি নয়, কৃষ্ণাঙ্গের অনুভবকে উপলব্ধি করতে হবে এবং স্থাপন করতে হবে। মানবসভ্যতার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আজ আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
(লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি)
ছবি: সংগৃহীত।