বেঙ্গালুরুর একটি বিক্ষোভ সমাবেশে। ফাইল চিত্র
অ্যানাটমির স্যার একটি মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎই দেহটি দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন করে উঠলেন— ‘‘বল তো এই ব্যক্তির ধর্ম, বর্ণ, জাত কী? তোরা তো রাস্তায় নেমে বাস, ট্রেন, সরকারি সম্পত্তি জ্বালিয়ে রাজনীতিতে নেমেছিস— তা এই মৃতদেহটি কোন দলের?’’
না মানুষের কোনও ধর্ম, জাত, বর্ণ হয় না। কিছু রীতিনীতি, নিয়মকানুন, সংস্কার মানুষের প্রতিটি শ্রেণি আলাদা রাখতে পারে, কিন্তু আমাদের একটাই পরিচয়। বায়োলজিক্যালি। আমরা মানুষ। একটি মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মা-বাবা, পরিবার তাকে কিছু শেখায় ততদিন সে শুধুমাত্র মানবশিশুই থাকে। ঠিক যে মুহূর্ত থেকে তাকে শেখানো হয় সে কোন ধর্ম, কোন জাতের, সেই মুহূর্ত থেকে মানবধর্ম চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে সে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে যায়। দূরত্ব তৈরি হয় অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে।
কিন্তু যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা চিন্তা করি বা বিষয়ের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি তবে আমরা বুঝতে পারব যে এই বিভাজনের তত্ত্ব খাঁড়া করে যাঁরা আমাদের আলাদা করার চেষ্টা করছেন, তা পুরোটাই মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমরা যদি মানুষের পূর্বপুরুষের জিনতত্ত্ব নিয়ে একটু গভীরে যাই তবে দেখব আমরা একই আদিম আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স) থেকে সকলেই উদ্ভুত। খুবই সম্প্রতি মানুষের বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চমানের যে জেনেটিক স্টাডি করা হয়েছে, সেই বিষয়ে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হলেই আমরা পুরো বিষয়টি বুঝতে পারব।
পৃথিবীর আদিম আধুনিক মানুষ ৭৫ হাজার পূর্বে— আফ্রিকা মহাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়েছে। এই বিভিন্ন মহাদেশের মানুষের মধ্যে আফ্রিকায় উদ্ভূত মানুষের পূর্বপুরুষের জিনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। সেই জিন রয়েছে মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ বা এমটি ডিএনএ-এর মধ্যে। মাইটোকনড্রিয়া, যা কোষের শক্তিঘর হিসাবে পরিচিত, সেই অঙ্গাণুর মধ্যেও এক বা একাধিক ডিএনএ থাকে। একে মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ বা এমটি ডিনএনএ বলা হয়। এই এমটি ডিএনএ-র বিশ্লেষণ করে মানুষের মাতৃবংশ পরম্পরা বোঝা হয়। এর মধ্যেই রয়েছে এল-৩ টাইপ জিন, যা ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়। উত্তর ভারত হোক বা দক্ষিণ ভারত, ভারত ভূখণ্ডের সব মানুষের কোষেই এই এল-৩ জিনটি রয়েছে। বাকি এল-১ থেকে এল-সি (১৫টি রূপভেদ) পাওয়া যায় আফ্রিকার মানুষের মধ্যে।
অন্য দিকে, Y ক্রোমোজোমে থাকে R1a1 জিন। সেই জিনের R1a1Z93 রূপভেদ সম্পন্ন মানুষই ইউরেশিয়া থেকে ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল। বৈদিক যুগের মানুষের দেহাংশের অবশেষের ডিএনএ পরীক্ষা করে সেখানে এই R1a1Z93 প্রকারের জিন-এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ, বৈদিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তথাকথিত ‘বহিরাগত’দের হাত ধরে। এই জিনের অস্তিত্ব রয়েছে ইরান, আফগানিস্তান এমনকি, সাইবেরিয়ার মানুষের ডিএনএ’তে। অন্য দিকে, দক্ষিণ ভারতীয় ভূখণ্ডের মানুষ, রাখিগড়ি ও সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া মানুষের দেহাংশের ডিএনএ-র মধ্যে কিন্তু এই R1a1Z93 জিনটি নেই।
অর্থাৎ, বৈদিক যুগের মানুষ এবং দক্ষিণ ভারতের মানুষ তথা সিন্ধু সভ্যতা বা রাখিগড়ি সভ্যতার মানুষ উভয়েই ভারত ভূখণ্ডের বাসিন্দা হলেও (এল-৩ জিন থাকলে ভারত ভূখণ্ডের বাসিন্দা), বৈদিক যুগের মানুষ বহিরাগত এবং পরে আসা। কারণ, এদের ডিএনএ’তে রয়েছে R1a1Z93 জিন, যা আদি বাসিন্দা অর্থাৎ, সিন্ধু সভ্যতার মানুষ বা দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের ডিএনএ’তে নেই। সিন্ধু সভ্যতা বা রাখিগড়ি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে এবং বৈদিক যুগের শুরু প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। তাহলে ভারত ভূখণ্ডে কারা বহিরাগত আর কারাই বা মূলবাসী? তবে কি এখন মানুষের বংশলতিকা এবং জিনতত্ত্ব বিচার করে এই ‘বহিরাগত’দের দেশের বাইরে বার করে দেওয়া উচিত?
বিষয়টা খুব সহজ ভাবে বললে, আমাদের কারও যখন রক্তের প্রয়োজন হয় কিংবা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় তখন আমরা বর্ণ, ধর্ম, জাতির বিচার করি না। চিকিৎসক যখন রোগী দেখেন কিংবা শিক্ষক যখন ছাত্রছাত্রী পড়ান তখন তাঁরা কোনও ভেদাভেদ রাখেন না। তবে অধিকার পাওয়া বা না পাওয়ায় কেন ভেদাভেদ থাকবে? খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের স্বাভাবিক চাহিদা ভুলে আমরা যখন বিভেদের লড়াই নিয়ে মেতে উঠি, তখন সমাজকে আমরা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিই।
এই অন্ধকারের জন্যই আমরা ১০৩ তম ক্ষুধার দেশে বাস করি। কেন আমরা জাপান হতে পারি না। যে দেশ ১৯৫২ সালে স্বাধীন হয়ে গুঁড়িয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হতে পারে, যে দেশে ৮০ বছরের উপরে মানুষের গড় আয়ু। যে দেশে এত ধর্মীয়, জাতিগত, সাম্প্রদায়িক লড়াই হয় না। যে দেশের মানুষ উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছেও সাইকেলে বা হেঁটে অফিস বা স্কুল, কলেজে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানী যদি এগিয়ে যেতে পারে, ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা পাওয়া ভিয়েতনাম যদি অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ হতে পারে, তবেআমরা কেন পিছিয়ে? আমরা পারি না কেন?
আশার কথা, বর্তমান তরুণ সমাজের এক বৃহত্তর অংশ এই বিভেদ নীতির সম্মুখ বিরোধিতায় নেমেছে। আমাদের উচিত ওদের হাত শক্ত করা। মানুষের মধ্যে সচেতনতার প্রসার ঘটানো। মানুষকে বোঝানো, ধর্ম সুস্থ জীবনযাপনের দর্শন, মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টির উপকরণ নয়।
লেখক চিকিৎসক, পুরুলিয়া বিজ্ঞানমঞ্চের সম্পাদক