২০২০ সালের মার্চ মাস শেষ হওয়ার আগেই নাকি কেন্দ্রীয় সরকার এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম-সহ বেশ কয়েকটা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে দেবে। ঋণ-অতিরিক্ত মূলধনী আয়ের পরিমাণ বাড়াতে ‘স্ট্র্যাটেজিক সেল’। তাতে ‘স্ট্র্যাটেজি’ বা কৌশলটা ঠিক কী? সেই কৌশল হল, কর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ যখন কমছে, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে সেই টাকায় জিডিপি-র অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ স্বস্তিজনক সীমায় বেঁধে রাখা।
২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমান ছিল, মোট কর-রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪.৮৪ লক্ষ কোটি টাকা (সংশোধিত হিসেব)। দেখা গেল, রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৩.১৭ লক্ষ কোটি টাকা। কাজেই, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ ১.৬৭ লক্ষ কোটি টাকায় ঠেকল। এ বছর পরিস্থিতি আরও মারাত্মক। অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে কর-রাজস্বের পরিমাণ ৬.০৭ লক্ষ কোটি টাকা। গত অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে মোট রাজস্বের ৪৪% আদায় হয়েছিল। যদি ধরে নিই, এ বছরও সেই অনুপাতটা ঠিক থাকবে, তা হলে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে মোট কর-রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩.৭২ লক্ষ কোটি টাকা। এ দিকে, এ বছর সরকার ১৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা কর-রাজস্ব আদায় হবে বলে ধরে নিয়েছে। অতএব, ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২.৭৭ লক্ষ কোটি টাকা। তার ওপর, সরকার এ বছর ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার কর্পোরেট কর ছাড় ঘোষণা করেছে। সব মিলিয়ে, এই অর্থবর্ষে মোট কর-রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে চার লক্ষ বাইশ হাজার কোটি টাকায়— ২০১৯-২০ সালের প্রত্যাশিত জিডিপি-র দুই শতাংশের বেশি।
এ বার রাজকোষ ঘাটতির হিসেবটা দেখা যাক। মোট কর-রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ১৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা হবে, সেটা ধরে নিয়েই রাজকোষ ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল জিডিপি-র ৩.৩ শতাংশে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ঘাটতি যদি সত্যিই ওপরের হিসেব অনুযায়ী বাড়ে, তা হলে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের কারণেই রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫.৩ শতাংশে। ধরে নেওয়া যায়, রাজ্যগুলোর রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ জিডিপি-র ৩.৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। তা হলে, ২০১৯-২০ সালে দেশের মোট রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ পৌঁছে যাবে প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি।
আন্তর্জাতিক লগ্নিকারীরা রাজকোষ ঘাটতির বাড়াবাড়িকে মোটেই ভাল চোখে দেখেন না। মুডিজ়-এর মতো সংস্থাও ভারতের রেটিং কমাবে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ— ২০২০ সালের ৩১ মার্চের আগে, অর্থাৎ অর্থবর্ষ ফুরানোর আগে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে সেই টাকায় রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে দেখানো। বেচে দিতে সরকার এত ব্যস্ত কেন, বোঝা যায়। মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, কিছু দিন আগেই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক তার লভ্যাংশ (ও কনটিনজেন্সি ফান্ড) থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা দিয়েছিল।
বিলগ্নিকরণ জিনিসটা আসলে কী? সহজ কথায়, বিলগ্নিকরণ মানে হল, সরকার শিল্পখাত থেকে নিজের লগ্নি তুলে নিচ্ছে। অর্থাৎ, বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে রাজকোষ ঘাটতি কমানোর আসল মানে হল, সরকার নিজের ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে ঘাটতি কমাচ্ছে। নিতান্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, কারণ সরকারি খরচ কমলে অর্থনীতির বৃদ্ধির হারও কমবে, কর-রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও কমবে। অন্য দিকে, মন্দার মুখে পড়ে সরকার সামাজিক ক্ষেত্রে এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণও ভাল রকম কমাচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতি এখন থমকে আছে চাহিদার অভাবে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ কমলে কর্মসংস্থান আরও কমবে। এবং, শেষ অবধি জিডিপি-র অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়বে। অর্থাৎ, ফিসকাল ম্যানেজমেন্টের নীতি হিসেবেও সরকারের সিদ্ধান্তটা খারাপ। তা হলে, এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ কী? জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সেই কাজটা করের হার বাড়িয়ে করলে চলবে না, কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমিয়ে করতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ভারতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কোনও গোত্রের করের হারই কম নয়। সমস্যা হল, খুব বেশি লোকের থেকে কর আদায় করা যায় না। দেশের বেশির ভাগ মানুষই যতটুকু আয় করেন, তা করযোগ্য নয়। বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অতি সীমিত, ফলে পরোক্ষ কর আদায়ের পরিমাণও কম। করের পরিমাণ বাড়ানোর পথ কী তবে? বিত্তকর আরোপ করা, বংশানুক্রমে পাওয়া সম্পত্তির ওপর কর আরোপ করা ইত্যাদি। কিন্তু, ভারতে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। সেই ফাঁকটা বন্ধ করা গেলেও অনেক দূর কাজ হয়। তার জন্য কর প্রশাসনকে আরও কুশলী করতে হবে, ট্যাক্স ইনফর্মেশন নেটওয়ার্ক-কে জোরদার করতে হবে, এবং দুর্নীতি কমাতে হবে।
কর আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর পথটা কঠিন, সন্দেহ নেই। তাই সরকার সহজতর পথ বেছে নিয়েছে— রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার পথ। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি বিক্রি করলে সরকারি ব্যয় বাড়বে না ঠিকই, কিন্তু রাজস্ব ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। বস্তুত, বিলগ্নিকরণ থেকে পাওয়া টাকাটাকে যদি হিসেবের বাইরে রাখা যায়, তবে যেখানে বৃদ্ধির হার কমছে, কর্মহীনতা বাড়ছে, সেখানে জিডিপি-র অনুপাতে সরকারের মোট মূলধনী ব্যয়ের পরিমাণ কমছে। একটা কথা ভেবে দেখার মতো— এক কালে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো তৈরি হয়েছিল করদাতাদের টাকায়, আর এখন যারা কর ফাঁকি দেয়, এই সব সংস্থা বেচে তাদের ফাঁকি দেওয়ার ফলে তৈরি হওয়া ঘাটতি মেটানো হচ্ছে। সবচেয়ে বিপদ, কোনও বিরোধী পক্ষই এই সিদ্ধান্তের তেমন প্রতিবাদ করছে না।
(লেখক: সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি)