প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে কথা বলছেন, দুম করে এ রকম একটা কথা লিখে দিলে মুশকিল— জেলখানা জায়গাটা খুব সুবিধার বলে মনে হয় না। তার চেয়ে বরং বলি, অর্থনীতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যাহা বলেন, তাহা পোস্ট ট্রুথ। সত্যের সীমানা পেরোলে কোথায় পৌঁছনো যায়, সেই দার্শনিক তর্ক থাক— আপাতত বলি, দিনকয়েক আগেও ব্রিকস-এর সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বুক ঠুকে বলে এসেছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলার মাপের অর্থব্যবস্থা হবেই। তার জন্য প্রতি বছর গড়ে আর্থিক বৃদ্ধির হার কত হতেই হবে, প্রধানমন্ত্রী বলেননি। তবে, পাঁচ বছরে অর্থনীতির আয়তন কার্যত দ্বিগুণ করতে হলে প্রতি বছর গড় বৃদ্ধির হার কত হওয়া উচিত, সেটা নিতান্ত পাটিগণিতের হিসেব। উত্তর হল, বছরে প্রায় ১২ শতাংশ। সম্প্রতি জানা গেল, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই তিন মাসে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশ। এবং সেটাও নাকি গণনাপদ্ধতিতে খানিক জল মেশানোর কল্যাণে, নয়তো বৃদ্ধির হার মেরেকেটে আড়াই শতাংশের কাছাকাছি।
নভেম্বরের শেষে যে এই বোম ফাটবেই, দিন পনেরো আগেও সে বিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না প্রধানমন্ত্রীর? অর্থশাস্ত্রে তাঁর দখল খুব পোক্ত, আইটি সেলও এমন কথা মুখ ফুটে বলতে পারবে না। কিন্তু, হাজার হোক দেশের প্রধানমন্ত্রী তো বটে— আমলা-কর্তা-বিশেষজ্ঞ, কেউ তাঁকে জানাননি যে অর্থনীতির এ-হেন নাভিশ্বাস উঠছে? গাড়ি থেকে বিস্কুট, সব কিছুর বিক্রি কমেছে, গত ছ’বছরে নব্বই লক্ষ মানুষের চাকরি গিয়েছে— এ সব দেখেও কিচ্ছুটি বুঝতে পারেননি তিনি? না কি, সব জেনেবুঝেও পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের গল্প শুনিয়ে চলেছেন? কারণ তিনি জানেন, সেই মহাশৃঙ্গে পৌঁছতে হলে বৃদ্ধির হার কত হওয়া উচিত, আর তাঁরা তার তিন ভাগের এক ভাগেও পৌঁছতে পারছেন কি না, সাধারণ মানুষ এই হিসেব কষবে না? অন্য কেউ তা ধরিয়ে দিলে তাকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলে দেগে দেওয়া যাবে?
অর্থনীতি সম্বন্ধে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কোনও ধারণা নেই, এবং তাঁর চার পাশে এমন কেউ নেই যিনি সাহস করে সত্যিটা তাঁকে বুঝিয়ে বলতে পারেন, এই সম্ভাবনাটা বেশি ভয়ের? না কি প্রধানমন্ত্রী সজ্ঞানে ‘পোস্ট-ট্রুথ-ভাষণ’ করেন, এই সম্ভাবনাতেই ভয় পাওয়ার কারণ বেশি? উত্তরটা নিজের পছন্দমতো বেছে নিতে পারেন। কিন্তু, গল্পটা যে নিখাদ ভয়ের, তাতে সন্দেহ নেই।
ভয়ের কারণ কি একা প্রধানমন্ত্রী? তাঁর অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নন? একের পর এক ধাক্কার খবর এসেছে, আর তিনি জোর গলায় বলে চলেছেন, চিন্তার কোনও কারণ নেই। শেষ অবধি স্বীকার করেছেন বটে যে, অর্থনীতি খানিক গাড্ডায় পড়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে নিজের অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বলেছেন, কিসের মন্দা? পর পর দুটো ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির আয়তন না কমলে তাকে মন্দা বলে নাকি? শুধু এটা বলেননি, গত কয়েক দশকে যত বার ‘মন্দা’ হয়েছে— দেশের আর্থিক অবস্থাকে সরকার ‘মন্দা’ বলে স্বীকার করে নিয়েছে— তার জন্য কেউ পাঠ্যবইয়ে দেওয়া সংজ্ঞার শর্তপূরণের অপেক্ষা করেননি। বলেননি, উন্নয়নশীল অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কেন, সেই কারণটা বিশেষ জটিল নয়। উন্নত দেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের একটা বড় ফারাক হল, ধরে নেওয়া হয়, প্রথমটিতে দেশের যাবতীয় রিসোর্স বা আর্থিক সম্পদ— জমি এবং মূলধন— ব্যবহৃত হচ্ছে উৎপাদনের কাজে। তার উৎপাদনশীলতা যতটা হওয়া সম্ভব, ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। ফলে, সেখানে আর্থিক উৎপাদন একটা সুস্থায়ী হারে চলতে থাকে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, উন্নত দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশের ওপর কার্যত যায় না বললেই চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই যেমন ১৯৯০ থেকে ২০১৮ অবধি সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির হার হয়েছিল ১৯৯৯ সালে, ৪.৮%। বছরে গড়পড়তা দুই শতাংশ বৃদ্ধিই সেখানে দস্তুর। আর্থিক বৃদ্ধির জন্য সেখানে প্রযুক্তিগত উন্নতি বা অন্য কোনও পথে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। সেটা খুব দ্রুত হারে হওয়া কঠিন। অন্য দিকে, উৎপাদনশীল দেশে অব্যবহৃত আর্থিক সম্পদ আছে। প্রযুক্তিগত উন্নতি না ঘটলেও, শুধু এত দিন অব্যবহৃত থাকা সম্পদকে ব্যবহার করেই আর্থিক বৃদ্ধি হতে পারে। দ্রুত হারে উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে বছরে পাঁচ শতাংশের কম আর্থিক বৃদ্ধি যে ঘোর চিন্তার কথা, নির্মলা সীতারামন বলেননি। জানেন না বলেই কি?
অর্থনীতির ছাত্রী হয়ে এটুকু না জানা খানিক অস্বাভাবিক, সেটা বলতেই হয়। তার চেয়ে ধরে নেওয়া ভাল যে তিনি এই কথাটা বেমালুম চেপে গিয়েছেন। কৃষি থেকে শিল্প উৎপাদন, রিয়াল এস্টেট থেকে বিদ্যুৎ, সব ক্ষেত্রেই যখন বৃদ্ধির হার হুহু করে কমতে থাকে, তাকেই যে মন্দার অনিবার্য চিহ্ন হিসেবে স্বীকার করে নিতে হয়, নির্মলা সীতারামন বলেননি এই কথাটাও। দেশের অর্থমন্ত্রী যখন এ-হেন প্রতারণা করেন, তখন ভয় করবে না?
অশীতিপর শিল্পপতি রাহুল বজাজ সাহস করে, বস্তুত দুঃসাহসী হয়ে, একটা অন্য ভয়ের কথা বলেছিলেন অমিত শাহকে— এই দেশে শিল্পপতিরা সরকারকে কোনও প্রশ্ন করতে, সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পান। রাহুল বজাজের আগেও কথাটা বেশ কয়েক জন বলেছেন। তাঁরা অবশ্য শিল্পপতি নন, অর্থনীতিবিদ। এক জনের নাম মনমোহন সিংহ। আর এক জন রঘুরাম রাজন। তৃতীয় জন কৌশিক বসু। নিজেদের মতো করে তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এখন কী ভাবে যে কোনও সমালোচনাকে, এমনকি প্রশ্নকে, সরকারের বিরুদ্ধতা বলে ধরে নেওয়া হয়। এবং, সমালোচনার কণ্ঠরোধ করার এই অভ্যাস কী ভাবে এক দিকে লগ্নিকারীদের মনে ভারতের অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে ভরসা কমায়, আর অন্য দিকে সরকারি নীতিতে ভুল হওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। কথাটা বেশ কয়েক মাস ধরেই বলছেন। সরকার পাত্তা দেয়নি।
রাহুল বজাজ অমিত শাহকে কথাটা বলার পর তাঁকে ছেঁকে ধরলেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। অনেকেই অনেক তির ছুড়লেন, কিন্তু তার মধ্যে নির্মলা সীতারামনের কথা আলাদা করে বলি। নির্মলা বললেন, প্রশ্ন করতে চান করুন— কিন্তু, নিজের ধারণার কথা এ ভাবে জনসমক্ষে বললে জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে।
‘জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি’ বিজেপির খুব পছন্দের অস্ত্র। অতিব্যবহৃতও বটে। কিন্তু, এত দিন সেই অস্ত্র চলেছিল সামাজিক ক্ষেত্রে— কখনও জেএনইউ-এর ছাত্রদের বিরুদ্ধে, কখনও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে, কখনও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে। তাঁদের মনে ভয়ের কাঁপুনি ধরানোর জন্যই। রাহুল বজাজ সম্বন্ধে কথাটা কি না-ভেবে, অভ্যাসবশে, বলে ফেললেন নির্মলা? না কি, এটা হুমকি— বেশি প্রশ্ন করলে দেশদ্রোহী বানিয়ে ছেড়ে দেব?
রাহুল বজাজ ভয় পেয়েছেন কি না, জানা নেই। আমার-আপনার কিন্তু ভয় পাওয়া উচিত। প্রবল ভয়। কোনও এক জন ‘কংগ্রেস-ঘেঁষা’ শিল্পপতিকে হয়রান করা হবে, সেই ভয় নয়। যে সত্যকে এমন প্রাণপণ লুকোতে চাইছেন মোদী-শাহ-নির্মলারা, সেই অজানাকে ভয়। লুকোচ্ছেন তো তাঁরা বটেই। পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে দিচ্ছেন না— গোটা দুনিয়া জুড়ে নিন্দা হলেও তোয়াক্কা করছেন না তাতে। ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বহু কোটি টাকা খরচ করা হলে সেটা কর্পোরেট কর-এ ছাড় হিসেবে কেন দিতে হবে, কেন সামাজিক ক্ষেত্রে খরচ করা হবে না টাকাটা— উত্তর দেননি তাঁরা। সবচেয়ে বড় কথা, নরেন্দ্র মোদী আজ অবধি জানাননি, উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে-আগেই কেন নোট বাতিল করতে হল? জানাননি, ঠিক কী উদ্দেশ্য ছিল সেই দেশব্যাপী মহাতাণ্ডবের, আর তার কতখানি পূর্ণ করতে পারল সরকার। তিন বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আজকের এই হাঁড়ির হালের পিছনে নোট বাতিলের ভূমিকার কথা খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদরা। সরকারের নীরবতা ভাঙেনি।
শুধুই কি নিজেদের অপদার্থতা লুকোচ্ছেন তাঁরা? আকাশছোঁয়া অহঙ্কার তাঁদের ভুল স্বীকার করতে, ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতে আটকাচ্ছে বলেই এই গোপনীয়তা? না কি, এই গোপনীয়তার তলে তলে এমন কিছু ঘটছে, যা প্রকাশ্যে এলে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরে নোট বাতিলের ঘোষণা নামক বজ্রপাতকেও নেহাত ছেলেখেলা বলে মনে হতে থাকবে? আশঙ্কাটাকে উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল।
এর পরও ভয় করবে না?