চিদম্বরম
নরেন্দ্র মোদীর একটি বক্তৃতার কথা স্মরণে আসিতে পারে। লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে তিনি নিজের চৌকিদারিত্বের মহিমা বর্ণন করিতে করিতে বলিয়াছিলেন, পূর্বে যে দুর্নীতিগ্রস্তরা দাপাইয়া বেড়াইতেন, তাঁহার জমানায় তাঁহাদের কেহ আদালতের চক্কর কাটিতেছেন, কেহ জামিনে মুক্ত। মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা সমস্বরে জানাইয়াছিলেন, প্রত্যেককে জেলে পাঠাইতে হইবে। প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেন নাই, বলিলে অর্ধসত্য বলা হইবে। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ভারতের প্রাক্তন অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম। সমস্যা হইল, দেখা যাইতেছে যে প্রধানমন্ত্রী তাঁহার কথার অর্ধেকটি রক্ষা করিয়াছেন মাত্র। বিজেপির আদি বা নব্য, কোনও গোত্রের নেতার দুর্নীতিই সিবিআই বা ইডি দেখিতে পায় না। যে অভিযোগের ভিত্তিতে চিদম্বরমকে এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে গ্রেফতার করিল সিবিআই, বিজেপির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে তাহার সমান বা গুরুতর অভিযোগ আছে। যেমন, কর্নাটকের বি এস ইয়েদুরাপ্পা। জমি এবং খনি, দুইটি বড় কেলেঙ্কারিতে জড়িত ইয়েদুরাপ্পা চতুর্থ বার কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হইলেন। তাঁহার বাড়ি হইতে বিপজ্জনক নথি উদ্ধার হইয়াছে। অথচ, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক সিবিআই সে বিষয়ে নীরব। যেমন, শিবরাজ সিংহ চৌহান। ব্যাপম কেলেঙ্কারির ঘটনায় সিবিআই তাঁহারও দোষ খুঁজিয়া পায় নাই। যেমন, মুকুল রায়। যত দিন তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে ছিলেন, ইডি-র দফতরে তাঁহার নিয়মিত ডাক পড়িত। দল পাল্টাইয়া গৈরিকবর্ণ ধারণের পর আইনরক্ষকদের চক্ষুতে তিনি অদৃশ্য হইয়া গিয়াছেন। হিমন্ত বিশ্বশর্মা, বেল্লারির রেড্ডি ভ্রাতৃদ্বয়, নারায়ণ রাণে, রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক— উদাহরণের তালিকাটি দীর্ঘতর করা সম্ভব। সংশয় হইতেছে, নরেন্দ্র মোদীর সেই ভাষণটির সময় হয়তো টেলিপ্রম্পটারে অর্ধেক কথা পড়া গিয়াছিল মাত্র। দুর্নীতিগ্রস্তদের জেলে ভরিবার এই শপথটি যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এই কথাটি হয়তো ইতি গজ হইয়া গিয়াছিল।
যে ভঙ্গিতে চিদম্বরমকে গ্রেফতার করা হইল, কোনও সন্ত্রাসবাদীকে হাতের নাগালে পাইলে সম্ভবত সে ভাবে গ্রেফতার করিবার কথা। প্রাক্তন মন্ত্রী চিদম্বরম অগ্রিম জামিনের আবেদন লইয়া দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন, যাহা সকল নাগরিকের অধিকার। মামলার সহিত চিদম্বরমের সম্পর্কটিও খেয়াল রাখিতে হইবে। তিনি দেশ ছাড়িয়া পলাইবার পরিকল্পনা করিতেছিলেন বলিয়াই কি এই অভিযান? কেহ ভাগলবা হইবার ফিকির করিলেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁহার বাড়ির প্রাচীর টপকাইয়া ঢোকে, এ কথা বলিলে বিজয় মাল্য আর নীরব মোদী অট্টহাস্য করিবেন। অতএব, মধ্যরাত্রির এই তৎপরতার কারণটি মূলত রাজনৈতিক— কংগ্রেসই এই অভিযোগ করিয়াছে। অভিযোগ অস্বীকার করিবার মুখ সিবিআইয়ের আছে কি? ২০১৩ সালে বিচারপতি লোঢা সিবিআইকে ‘খাঁচার তোতা’ বলিয়াছিলেন। অনুমান করা চলে, আদালতের চোখেও ছয় বৎসরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হইয়াছে। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ খেদ প্রকাশ করিলেন, রাজনৈতিক প্রশ্নে সিবিআইয়ের তদন্ত আদালতের মানদণ্ডে অনুত্তীর্ণ। রাজনৈতিক অঙ্গুলিনির্দেশে পরিচালিত হইতে হইতে সিবিআইয়ের ন্যায় প্রতিষ্ঠান নিজের কষ্টার্জিত দক্ষতা হারাইয়া ফেলিতেছে, ইহা অতি দুর্ভাগ্যের। বিরোধীদের ভয় পাওয়ানো যে সিবিআইয়ের কাজ হইতে পারে না, শাসকদের মুখের উপর এই কথাটি বলিবার জোর সম্ভবত সিবিআই কর্তাদের নাই। অভিযোগ উঠিয়াছে, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নয় বৎসর পূর্বের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিতেই চিদম্বরমকে হয়রান করিতেছেন। অভিযোগটির সত্যাসত্য বিচার অবান্তর— এ হেন অভিযোগ ওঠাই কি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে যথেষ্ট লজ্জার নহে?