প্রতি দিন রাস্তা ঘাটে হেলমেট-বিহীন চালক ও তাঁদের সফরসঙ্গীদের দেখে ভাবি, এতটা অকুতোভয় তাঁরা কেমন করে হতে পারেন! অথবা শহরতলির ট্রেনে যাঁরা অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় যাতায়াত করেন, তাঁদের দেখে ভাবি, এ যেন দৈনন্দিন অ্যাডভেঞ্চার, বা নিজের প্রাণের উপর সমস্ত যুক্তিতর্ক-ব্যতিরেকে আস্থাজ্ঞাপনের বিজ্ঞাপন। তবে বিস্ময় জাগে, আপাতবিচারে অসীম-সাহসী এই মানুষগুলিকে কত সহজেই ভয় পাইয়ে দিতে পারেন রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিরা! নয়তো কেমন করে ব্যাখ্যা করা যাবে সদ্য (এবং অতীতেও) বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টদের উপরে অর্থহীন এবং নির্মম পুলিশি আক্রমণের পরেও অধিকাংশ ভারতবাসীর এই নীরবতাকে? কেমন করে বুঝতে পারব সম্প্রতি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণা অনুসারে নোটবন্দির ফানুস কার্যত ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা এখনও কেন এতটা স্তিমিতক্রোধ? অমর্ত্য সেনের সাবধানবাণীকেও অবজ্ঞা করতে শাসকপক্ষ সে দিন পিছপা হয়নি। অথচ আমরা ‘ধৈর্য’ ধরেছি। সে কি ধৈর্য, না ভয়? না কি শেষাবধি নিতান্ত ব্যক্তিগত বৃত্তের বাইরে বেরনোর ব্যাপারে সীমাহীন জড়তা?
একটা দৃষ্টান্ত দিই। হাসপাতালে প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমরা ধরেই নিই যেন একমাত্র চিকিৎসকের গাফিলতিতেই এমন মর্মান্তিক পরিণতি; তাই তাঁকে উত্তমমধ্যম দেওয়াই আপাতত কর্তব্য! বোধ হয় তাৎক্ষণিক এই অতি-তৎপরতা নাগরিক-ক্ষেত্রে প্রাত্যহিক যে জড়তায় ভুগে থাকি, তার থেকে খুব আলাদা নয়। এক দিকে যেমন প্রতি দিনের জমে থাকা ক্রোধের উন্মত্ত বিস্ফোরণ, তেমনই ‘নিজের ঘর পোড়ার’ ফলে আপন বলয়ের সুরক্ষার ব্যাপারে এত দিন বয়ে চলা যাবতীয় মায়াবী বিশ্বাসের নির্মম ভূপতন? ক্ষুদ্র স্বার্থবোধের কারবারি হতে গিয়ে আমরা কি বড় বেশি ছাপোষা হয়ে পড়ছি না? নিজের সন্তানের ‘দুধে-ভাতে’ থাকার বাইরে কি আর কিছু ভাবতে পারছি না? তাই বুঝি যথাযথ বেতন ও অন্যান্য চাকুরিগত সুযোগসুবিধার দাবিতে আমরা যেমন নিরন্তর কূটতর্ক করি ও মুখর হয়ে উঠি, তার বিপরীতে বৃত্তিগত মর্যাদার দাবিতে বা নানান সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধিকারের ব্যতিক্রম ঘটলে (এমনকি নিজের ভোট নিজে দেওয়ার প্রশ্নেও) প্রায়শ নির্বিকার ভাব বজায় রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি!
সেখান থেকেই কিছু প্রশ্ন জেগে উঠছে। কেন্দ্রের অদ্ভুত শাসনতন্ত্র যখন ক্রমাগত ব্যক্তি-অধিকারের ও যে কোনও প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করতে উদ্যত, ডিমনিটাইজ়েশন-জিএসটির মতো নানান উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় জনতাকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে সর্বদা ব্যগ্র, গোরক্ষার অজুহাতে নিরীহ মানুষের হত্যার ঘটনায় কর্ণপাতে অনিচ্ছুক, তখন প্রথমেই মনে হয় নির্বাচক-সংখ্যার বিচারে বৃহত্তম এই গণতন্ত্র এতটা সয়ে যেতে পারছে কী করে? কেমন করেই বা দিবারাত্র মিডিয়ায় নৃশংস ঘটনাগুলিকে প্রত্যক্ষ করে দিব্য কালাতিপাত করে চলেছে? নির্মমতার ঘটনাগুলি চাক্ষুষ করা আর ‘শেয়ার’ করাই কি সচেতনতার পরীক্ষা? প্রতিবাদ করতে এত যে ভয় তার উৎসই বা কী? কী জানি কোনও জটিল সামাজিক মনোরোগে আমরা আক্রান্ত কি না। আর এই ‘নিউরোসিস’-এর এক ‘লক্ষণ’ বা ‘সিম্পটম’ই যেন এমন অদ্ভুত ভয় বা প্যারানোইয়া। অপর এক লক্ষণ বুঝি বারংবার এই সব অনাচারকে দেখতে দেখতে, পরস্পরকে বলতে বলতে এক রকম ‘অনাসক্ত’ হয়ে পড়া। এই অদ্ভুত অনাসক্তি কার্যক্ষেত্রে, অর্থাৎ কিনা সামাজিক দায়িত্ববোধ-পালনেও নিরাসক্ত করে তোলে।
সম্প্রতি নানান দৈনিকে কল্লোল রায়চৌধুরির মৃত্যুর কথা পুনর্বার প্রকাশিত হচ্ছে। নোটবন্দির অব্যবহিত পরে টাকার সন্ধানে হতক্লান্ত-বিপর্যস্ত এই মানুষটি ব্যান্ডেল স্টেশনের কাছে একটি এটিএমের কিয়স্ক-এ টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে ‘হাইপার-টেনশন’-এ ভুগে ঢলে পড়ে যান। কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা নোটের হাহাকারের সেই লগ্নে বেশ কয়েক জন মরিয়া সহ-নাগরিক সে দিন অসহায় পড়ে-থাকা কল্লোলবাবুকে পাশ কাটিয়েও টাকা তোলেন বলে শোনা যায়। দেরির কারণে তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। এমন আত্মকেন্দ্রিকতার নিদর্শন তখন আরও দেখা গিয়েছে। এতটা আত্মসর্বস্ব আমরা স্বাভাবিক সময়ে হতাম না নিশ্চয়ই। এ প্রসঙ্গে বলি, অন্যতর প্রেক্ষিতে ডেস্পারেশন-এর সঙ্গে আত্মরতি বা নার্সিসিজ়ম-এর জটিল সামাজিক-মানসিক সম্পর্কের কথা সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী তাঁর ‘রেজিম্স অব নার্সিসিজ়ম, রেজিম্স অব ডেস্পায়ার’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। তবে সম্প্রদায় বা কমিউনিটিতে অভ্যস্ত ভারতীয়রা অনেক সময়েই ব্যক্তি-অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে হ্রস্ব-দীর্ঘ ভুলে যান, তা যে কোনও লাইনে দাঁড়ালেই দেখা যায়। যদি আপনি বিষম বিপদে পড়ে ট্রেন ধরতে হন্তদন্ত হয়ে এসে রেলের কাউন্টারে দীর্ঘ লাইনের মুখোমুখি হন, তবে সহ-নাগরিকদের কাছে সহমর্মিতা অনেক সময়েই পাবেন না। নাগরিক অধিকারগুলিকে কি আমরা বড় বেশি বিচ্ছিন্ন করে ভাবতে চাই? আমরা সেখানে কর্তব্য থেকে অধিকারকে স্বতন্ত্র করে ফেলি, এক ক্ষেত্রের কর্তব্যের সঙ্গে অন্য ক্ষেত্রের কর্তব্যকে আলাদা মনে করি; আবার ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতেও প্রবল রেষারেষি অনুভব করি। সমাজের যে ‘নাগরিক’ পরিসরটি আছে, আমরা কি নিজেদের শুধুমাত্র তার উপভোক্তার চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারি না? অথচ গণপরিসরটিকে সকলের হিতকর করতে গেলে সম্মিলিত দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া গতি কী?
নাগরিক মঞ্চগুলি সংখ্যায় নগণ্য, যেটুকু বা আছে তা জনতার উৎসাহের অভাবে দ্রুত রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। অনেক সময়ে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চৌহদ্দির ঘূর্ণিপাকে তার নাগরিক রূপটির সমাধি ঘটে। প্রখর রাজনৈতিক চাতুর্যবোধের কারণে ডিমনিটাইজ়েশন-এর রূপকারের এই ব্যাপারটি অজানা ছিল না নিশ্চয়ই। তবু তিনি দেশজোড়া এমন একটি ‘পরীক্ষা’ করে বুঝে নিয়েছিলেন কতটা কী হয়! আর আজও আমরা কিন্তু তা-ই দেখে চলেছি! নইলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের এই সাম্প্রতিক খতিয়ানের পরে এখনও কেউ ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন কি? দেশব্যাপী বিপুল অর্থক্ষয়, মানুষের জীবিকা, এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে জীবনের অপূরণীয় ক্ষতির পরে যখন বেলাশেষে কালো টাকা উদ্ধার, জাল নোট সমস্যার স্থায়ী সমাধান ইত্যাদি আজগুবি দাবিগুলির অন্তঃসারশূন্যতা প্রকট হয়ে পড়ল, তার পর পরই আবার গ্রেফতার হলেন অ্যাক্টিভিস্ট কবি, শিক্ষক ও সাংবাদিকরা! অনেক দিন আগে মহারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁওতে ঘটা দলিত-নির্যাতন ও হাঙ্গামার ঘটনা থেকে স্থান-কালের বহু দূরত্বে এসে পড়ে এই সব প্রতিবাদী ও সুপরিচিত মানুষগুলিকে আজ এমন ভাবে অভিযুক্ত করার ব্যাখ্যা অনেকটা বুদ্ধির কসরত করেও মেলে না।