কোভিড অতিমারিতে যে দেশগুলির রফতানি সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার অন্যতম ভারত। চলতি অর্থবর্ষের প্রথম চার মাস, মানে এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে, ভারত যত পণ্য রফতানি করেছে, তা গত বছরের এই সময়কালে রফতানির চাইতে ৩০ শতাংশ কম। তবে কৃষিপণ্যের রফতানি যে একটু বেড়েছে, বিশেষত খাদ্যশস্য আর তেলের, তাতে সরকারি আধিকারিকদের মুখে হাসি ফুটেছে। জুলাই ২০১৯-এর চাইতে এ বছর জুলাইয়ে বাসমতী-ভিন্ন চালের রফতানি বেড়েছে ৪৮ শতাংশ, অন্যান্য খাদ্যশস্য ২০৫ শতাংশ, এবং তৈলবীজ প্রায় ৩৩ শতাংশ। যদি এপ্রিল থেকে জুলাই, এই চার মাসের হিসেব ধরা হয়, তা হলে বৃদ্ধির বহরটা আরও স্পষ্ট হয়। এপ্রিল-জুলাই ২০১৯-এর চাইতে বাসমতী-ভিন্ন চালের রফতানি বেড়েছে ৫৬ শতাংশ, গমের রফতানি ১৩০ শতাংশ, ডাল প্রায় ২৮ শতাংশ।
এই বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে দুটো কারণে। এক, শস্য উৎপাদনে রেকর্ড বৃদ্ধি; আর দুই, জুনের গোড়ায় কেন্দ্রের তিনটি অধ্যাদেশ জারি, যার ফলে কৃষির বাজারে বিনিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন করা হয়েছে, যার ফলে খাদ্যশস্যের বাজারদরের উপর সরকারের নজরদারির দিন শেষ হল। অন্য দু’টি অধ্যাদেশের একটির উদ্দেশ্য কৃষিপণ্যের বাণিজ্য বাড়ানো। দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য ফসলের ক্রেতার (আড়তদার, পাইকার, খুচরো বিক্রেতা ও রফতানিকারী) সঙ্গে দরদস্তুর করায় চাষির সক্ষমতা বাড়ানো, যাতে চাষি নিশ্চিত ভাবে ফসলের ন্যায্য দাম পান। এই নিয়মের ফলে এখন সরকার-নিয়ন্ত্রিত বাজারের বাইরে গিয়ে চাষিরা সরাসরি ব্যবসায়ীর সঙ্গে বেচাকেনা করতে পারবেন।
এই অধ্যাদেশগুলি সম্পর্কে তিনটি প্রশ্ন করা দরকার। এক, ভারতের মানুষের একটা মস্ত অংশ যখন কাজ হারিয়ে খাদ্যাভাবের মুখোমুখি, তখন ভারতে উৎপন্ন ফসলের জন্য বাইরের বাজার খুলে দেওয়ার যুক্তি কী? দুই, যে দেশে চাষিদের ৯০ শতাংশের জমির পরিমাণ দুই হেক্টরের কম, সেখানে কী করে তাঁরা ব্যবসায়ী বা রফতানিকারীদের থেকে আরও ভাল দাম আদায় করতে পারবেন? তিন, ভারতের কৃষি যদি রফতানিমুখী হয়, তার কী কী ফল হতে পারে, তা কি ভেবে দেখা হয়েছে?
অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংশোধন বাস্তবিকই একটা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এমন একটা সময়ে তা খাদ্যের বাজার থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিল, যখন আগের চাইতেও বেশি করে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ অর্থনীতির সঙ্কট দেশবাসীর একটা বড় অংশকে এমন এক জায়গায় ঠেলে নিয়ে গিয়েছে, যেখানে খাবারের দাম সামান্য বাড়লেও তার প্রভাব হবে মারাত্মক। ভারতে সাধারণ ক্রেতা জুলাই মাসে যে দামে চাল-গম প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য কিনেছেন, তা গত বছরের তুলনায় প্রায় দশ শতাংশ বেশি। ডাল বা তেলের মতো নিতান্ত দরকারি দ্রব্যের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। কিন্তু সংশোধিত আইন বলছে, খুচরো বাজারে অন্তত ৫০ শতাংশ দাম না বাড়লে সরকার নিয়ন্ত্রণে নামতে পারবে না।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, নিয়ন্ত্রিত কৃষি বাজারের রাশ যে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল, তাঁরা চাষিকে ঠকিয়েছেন। কিন্তু সরকার চাষিকে সরাসরি বাজার ধরানোর যে সমাধান দিল, তা সমস্যার চাইতেও খারাপ। চাষি যার কাছে ইচ্ছে বিক্রি করতে পারবেন মানেই বাজার ধরে লাভবান হবেন, ছোট বা প্রান্তিক চাষির ক্ষেত্রে এটা কখনওই ধরা চলে না। জাতীয় কৃষক কমিশন (স্বামীনাথন কমিশন) বরং যুক্তি দিয়েছিল যে, বিপণনকে আরও উন্নত করলে, এবং কৃষকদের সংগঠনগুলিকে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিলে, ফসল থেকে চাষির লাভ বাড়তে পারে। ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে নিতান্ত কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েন ছোট চাষি। দালাল আর ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে যান তাঁরা। সরকারি অধ্যাদেশ কিন্তু কৃষির বাজারে ব্যবসায়ীর দাপট আরও বাড়িয়ে দিল।
তবে সব চাইতে বড় প্রভাব ফেলবে ভারতের কৃষিকে রফতানিমুখী করে তোলার অধ্যাদেশ। গত পাঁচ দশকে কৃষিনীতি দুটো প্রধান লক্ষ্য পূরণ করতে চেয়েছে— গৃহস্থের (এবং দেশের) খাদ্য নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ জীবিকার নিরাপত্তা। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ভারত যখন মুক্ত বাজার নীতি নিল এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দিল, তখন এই নীতির তাৎপর্য আরও বেশি করে সকলে উপলব্ধি করল। কারণ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সব চাইতে বিতর্কিত বিষয়ের একটা ছিল বিশ্বায়িত কৃষি বাজারের প্রস্তাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে প্রস্তাব সমর্থন করেছিল। ভারতের অবস্থান তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সূচনা-বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, “ভারতের ‘জীবনসূত্র’ কৃষকদের স্বার্থের সুরক্ষা এবং ভারতবাসীর খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি ভারত সরকার দায়বদ্ধ।” এই অবস্থান নেওয়ার ফলে সরকার আমদানি-করা কৃষিপণ্যে চড়া হারে শুল্ক বসাতে পেরেছিল। না হলে মার্কিন বা ইউরোপীয় কৃষিপণ্য আমাদের বাজার দখল করে নিত, যা সত্যিই ঘটেছে বহু উন্নয়নশীল দেশে।
পরবর্তী কালে মুক্ত বাণিজ্যের পরিধি বাড়ানোর একাধিক বৈঠকে উন্নয়নশীল অন্য দেশগুলির সঙ্গে (জি-৩৩) ভারতও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় জোরের সঙ্গে সওয়াল করেছে যে, উন্নয়নশীল দেশে কৃষির প্রধান উদ্দেশ্য খাদ্য নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান। সেই উদ্দেশ্যে নীতি গ্রহণ করা দরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য রফতানিকারী দেশের চাপ প্রতিহত করতে এই কৌশল কাজে দিয়েছিল। ভারত বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি করে, কিন্তু কৃষি সম্পর্কে অবস্থানে অনড় থাকে। এর ফলে তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো রফতানিকারী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেও ভারতের কৃষির বাজারকে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছে সরকার। বেশ কিছু এমন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থমকেও রয়েছে, কারণ ভারত কৃষির বাজার খুলে দিয়ে তার ছোট চাষিকে বাইরের চাষির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে দিতে চায় না।
এখন ভারত সরকার কৃষিনীতির যে পরিবর্তন চাইছে, তার সম্ভাব্য ফল আন্দাজ করা কঠিন নয়। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির জন্য যে সব দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে, কিংবা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য যে সব দেশ, তারা ভারতের এই দ্বিচারিতা মানতে রাজি হবে না। ভারত অন্য দেশে রফতানি করবে, কিন্তু নিজের বাজারকে চড়া শুল্কের আড়ালে রাখবে, তা কী করে হয়? ভারতকে কৃষি বাজার খুলতে হবে। কিন্তু তার আগে দেশের যে ষাট শতাংশ মানুষ জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল, তাঁদের জীবিকার সুরক্ষার কী হবে, সে কথা সরকারকে ভাবতে হবে। সেই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার কথাটাও।
অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়