subhas chandra bose

উদ্দেশ্য আর পথ

মার্ক্সবাদীদের হয়তো মনে হইয়াছে যে, হৃত জনসমর্থন পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিকতাবাদ জলাঞ্জলি দিয়া জাতীয়তাবাদ বরণ করা শ্রেয়। ভারতীয় জনতা পার্টি যদি উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করিয়া ভোট-বৈতরণি পার করিতে পারে, তাহা হইলে দেশপ্রেম প্রচার করিতে মার্ক্সবাদীরাই বা কম কিসে? অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পথ যদি ঘোষিত আদর্শের পরিপন্থী হয়, তাহাতে ক্ষতি নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: শাটারস্টক

লক্ষ্য অথবা পথ— কোনটিকে বড় জ্ঞান করা শ্রেয়? চিন্তাশীল ব্যক্তির নিকট এক বড় প্রশ্ন বটে। অবশ্য, আশু প্রয়োজন মিটাইতে উদ্‌গ্রীব যে মানুষ, তাহার নিকট উক্ত প্রশ্নটি অকিঞ্চিৎকর। প্রয়োজন এমনই এক বড় দায় যে, তাহার চাপে অনেকে অতিষ্ঠ। এবংবিধ ব্যাপারে উৎকৃষ্ট উদাহরণ বোধ হয় এ-ক্ষণে এই রাজ্যে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। চৌত্রিশ বৎসর পশ্চিমবঙ্গ শাসনের পর্ব অতিক্রান্ত। গত প্রায় নয় বৎসর দলটি ক্ষমতায় নাই। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির সাঁড়াশি চাপে দলটির দুর্দশা। তাই হয়তো ওই পার্টির মুখে এ-ক্ষণে আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ। যে সুভাষচন্দ্র বসু নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের সাহায্য লইয়া ইংরাজ শাসনাধীন ভারতকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন, ফলত বহু কাল ছিলেন বামপন্থীদের নিন্দার শিকার, তাঁহারই জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি দেশপ্রেম দিবস হিসাবে পালন করিতে চায়। এই মর্মে সরকারকে আর্জিও জানাইয়াছে দলটি। মার্ক্সবাদীদের হয়তো মনে হইয়াছে যে, হৃত জনসমর্থন পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিকতাবাদ জলাঞ্জলি দিয়া জাতীয়তাবাদ বরণ করা শ্রেয়। ভারতীয় জনতা পার্টি যদি উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করিয়া ভোট-বৈতরণি পার করিতে পারে, তাহা হইলে দেশপ্রেম প্রচার করিতে মার্ক্সবাদীরাই বা কম কিসে? অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পথ যদি ঘোষিত আদর্শের পরিপন্থী হয়, তাহাতে ক্ষতি নাই। প্রসঙ্গত, এই রূপ মত ও পথের প্রভেদ লইয়া বিতর্ক নানা ক্ষেত্রে নানা ভাবে শুনা যায়। কিছু বৎসর পূর্বে এমনই এক বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন কলিকাতার গর্ব মাতা টেরিজা। তিনি অনাথ আশ্রমের জন্য মুম্বইনিবাসী ধনী অথচ জনৈক দুর্বৃত্তের দান গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া সবিশেষ নিন্দার সম্মুখীন হইয়াছিলেন। অসদুপায়ে অর্জিত ধন মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যয় করা সমীচীন কি না, তাহা লইয়া অনেকে বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।

Advertisement

অনুরূপ আর একটি বিতর্ক এ-ক্ষণে গবেষণাকে ঘিরিয়া শুনা যাইতেছে। আমেরিকায় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিখ্যাত মিডিয়া ল্যাব-এর প্রধান জোইচি ইটো পদত্যাগও করিয়াছেন বিতর্কের চাপে। অভিযোগ? তিনি যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ধনকুবের জেফ্রি এপস্টাইনের নিকট হইতে ১৭ লক্ষ ডলার দান গ্রহণ করিয়াছিলেন। নানা বিষয়ে গবেষণার জন্য মিডিয়া ল্যাব প্রসিদ্ধ। গবেষণার ব্যয়ভার বহন করিবার নিমিত্ত ইটো যে উক্ত বদান্যতার প্রত্যাশী হইয়াছিলেন, তাহা বলা বাহুল্য। কিন্তু তাহাতে নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করা যায় নাই। অভিযুক্ত এপস্টাইন আত্মহত্যাও করিয়াছেন। তথাপি ইটো এই মর্মে সমালোচিত হইয়াছেন যে, তিনি সব কিছু জানিয়া-শুনিয়াও এক জন অপরাধীর ভাবমূর্তি উন্নয়নে সাহায্য করিয়াছেন। ইহা কতকটা যেন একদা তামাকু শিল্পের নানা গবেষণায় অর্থ ঢালিয়া নিজ ভাবমূর্তি বদলাইবার প্রচেষ্টা। উল্লেখযোগ্য তথ্য এই যে, অপরাধীদিগের তরফে এবংবিধ উদ্যোগ থাকিতে পারে, কিন্তু তাই বলিয়া গবেষণার তরফে যে স্বখাত সলিলে ডুবিয়া মরিবার উদ্যোগ একেবারে নাই, তাহা বলা যায় না। ২০১১ সালে অকস্মাৎ আবিষ্কৃত হয় যে, প্রখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স এমন এক প্রতিষ্ঠান হইতে আর্থিক অনুদান লইয়াছে, যাহার পৃষ্ঠপোষক লিবিয়ার তৎকালীন নেতা মহম্মদ গদ্দাফি। ওই একই বৎসরে ইহাও জানা যায় যে, লস এঞ্জেলেস-এর ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা আইনসংক্রান্ত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত জনৈক লোয়েল মিলকেন হইতে ১ কোটি ডলার দান লইয়াছে। এই দাতা মিলকেন জুয়াচুরির সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী!

পুরাতন প্রশ্নটিতে ফিরা যাক। কথিত আছে, রবিন হুড ধনী ব্যক্তিদের লুণ্ঠন করিয়া দরিদ্রদের দান করিতেন। তাহার ওই রূপ দান কি স্বাগত? তাঁহার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যটি যদিও মহৎ তথাপি পথটি তদ্রূপ নহে। গবেষণায় ‘মানি’ আবশ্যক নিশ্চয়ই, তবে তাহা ‘ডার্টি মানি’ হইলেও কি স্বাগত? পৃথিবীর সর্বত্র গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগ ক্রমহ্রাসমাণ। গবেষণা, অতএব, ব্যক্তিগত ধনের প্রত্যাশী। যাঁহারা অসদুপায়ে প্রচুর বিত্ত সংগ্রহ করিতেছেন, তাঁহারা দান করিতে আগ্রহী। এমতাবস্থায় বিজ্ঞান গবেষণাকে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হইতে হইবে। যাহাকে বলে ‘টাইটরোপ ওয়াকিং’, তাহাই করিতে হইবে। অন্যথায় অপবাদ অবশ্যম্ভাবী।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

অস্ট্রেলিয়ার ন’বছরের একটি শিশু বামন সম্প্রতি সংবাদে। তার কম উচ্চতার জন্য স্কুলে তাকে এমন ‘বুলি’ করা হয়, অর্থাৎ এমন খ্যাপানো হয় ও চাঁটি-চাপাটি মেরে হেয় করা হয়, যে সে রোজ আত্মহত্যা করতে চায়। তার মা আর না পেরে, তার অসহায় ক্ষুব্ধ কান্নার একটি ভিডিয়ো আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গে তা ভাইরাল। শিশুটির সমর্থনে ও স্কুলে সহপাঠী-নিগ্রহের বিপক্ষে তারকারা সরব। কথা হল, আর কত দিন মানবিকতার প্রাথমিক পাঠগুলো ‘ভাইরাল’ হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement