খবরের কাগজের পাতায়, টিভি চ্যানেলের আলোচনায় নিত্যদিন ভারতের অঞ্চলে অঞ্চলে, বড় শহরে বা গণ্ডগ্রামে, মেয়েদের উপর যে যৌন অত্যাচার, নিপীড়নের কাহিনি পড়ি বা শুনি, তাতে যেন এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে নারী অবলা, যত শিক্ষিতই হোক না কেন সে সহজলভ্যা, তার উপর পশুপ্রবৃত্তির ভোগবাসনা অনায়াসে চরিতার্থ করা যায়। এক দিকে এই ঘৃণ্য ঘটনা ঘটছে, আর অন্য দিকে ষোড়শোপচারে দুর্গার আরাধনার আয়োজন চলছে।
মণ্ডপে মণ্ডপে দশপ্রহরণধারিণী, মহিষাসুরদলনী যে দেবীমূর্তি পূজিতা হচ্ছেন, আগমনি গানে, বাঙালি মননে তিনি হৈমবতী, মা মেনকার আদরিণী উমা, স্নেহময়ী জননী, আপনভোলা মহেশ্বরের প্রেমময়ী পত্নী— তবে ভারতীয় পুরাণে তিনি নারীশক্তি এবং অদ্বৈততত্ত্বের প্রতীক। দেবীর প্রাচীনতম মন্ত্র বলে পরিগণিত ঋগ্বেদ-এর ‘দেবীসূক্ত’-তে বলা হয়েছে, অম্ভৃণ ঋষির বাক নামক ব্রহ্মবাদিনী কন্যার উপলব্ধি হয় যে, বিশ্বচরাচরের যা কিছু সবই ব্রহ্ম এবং সব কিছুই তিনি, অর্থাৎ সেই নারী। তিনি বলেন যে, আমি রুদ্র, বসু, আদিত্য এবং বিশ্বদেবতারূপে বিচরণ করি; আমিই জগতের একমাত্র অধিশ্বরী, সমস্ত ভূলোক দ্যুলোক আমিই ব্যাপ্ত করে থাকি।
পুরাণে সর্ব জগৎব্যাপিনী সমস্ত দেবতার দ্বারা উপাসিতা এই মাতৃশক্তির কথাই বলা হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর অন্তর্গত ‘দেবী-মাহাত্ম্য’ নামক তেরোটি অধ্যায় সম্বলিত চণ্ডী নামে খ্যাত গ্রন্থের কোথাও দেবীকে জননী, জায়া, কন্যারূপে দেখা যায়নি। তিনি মূলত বীর্যশক্তির প্রতীক। তাই ‘দেবীদূতসংবাদ’ নামক পঞ্চম অধ্যায়ে দেখি অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভের ভৃত্য চণ্ডমুণ্ড নামক অসুরদ্বয় পার্বতীর অতীব মনোহরা রূপে মোহিত হয়ে তাঁদের প্রভু অসুরেশ্বর শুম্ভকে ওই স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। চণ্ডমুণ্ডের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে শুম্ভ দূতকে দেবীর কাছে পাঠালে দূত দেবীকে তাঁদের প্রভুদের শক্তির কথা মনে করিয়ে একাকী নারী হয়ে বিপুল বলশালী অসুরদের বিরোধিতা না করার উপদেশ দেন। এই উপদেশ থেকে পরিষ্কার যে, নারীকে প্রাথমিক দৃষ্টিতে অবলা, রূপসর্বস্ব বলে গণ্য করা হত। তাই অন্য পুরুষ যে কাজে সমর্থ নয়, সেই কাজে নারীর পারদর্শিতা থাকতে পারে, তা চিন্তাই করা যেত না। যখন সেই নারী যুদ্ধে একে একে অসুরসৈন্যের অধিপতি ধূম্রলোচন, চণ্ড, মুণ্ড, মহাসুর রক্তবীজ এবং অবশেষে নিশুম্ভকে ধরাশায়ী করে জয়ী হন— তখনও দৈত্য শুম্ভ বলেন, দেবীর সেই জয় দেবীর নিজস্ব নয়, তা অন্যের থেকে প্রাপ্তমাত্র, সেই কারণে সেই শক্তি নিয়ে গর্ব করার কিছু তাঁর থাকতে পারে না বলে অভিহিত করেন।
উত্তরে দেবী যা বলেন তা তো বেদান্ত-রই মূল তত্ত্ব: ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’, এ জগতে একমাত্র আমিই তো আছি, আমার থেকে অপর দ্বিতীয় আর কে আছে? এই দেবীই বিভূতিবিশিষ্ট হয়ে বহুরূপে অবস্থানকারী। যখন তিনি তাঁর সেই বিভূতি সংবরণ করেন, তখন তিনি একাই অবস্থান করেন। তাই অন্য দেবতাদের যে শক্তি তা সব দেবীরই নিজস্ব। ‘মধুকৈটভ বধ’ নামক প্রথম অধ্যায়ে ব্রহ্মা বলেন যে, সৎ অসৎ যেখানে যা বস্তু আছে সবই এই দেবী এবং এই শক্তিই সর্বভাবে বিরাজিত। চণ্ডী-তে দেবীর এই সর্বব্যাপী স্বাশ্রয়া, স্বতন্ত্রা রূপের কথাই বার বার তুলে ধরা হয়েছে। তিনিই সব এবং সমস্ত ঈশ্বরের ঈশ্বরী: সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী। তিনি পর এবং অপর উভয়েরই আশ্রয়, পরমেশ্বরী: দ্বয়রহিতা পরমেশ্বরী। শক্তিমানের সঙ্গে তাঁর অদ্বয়ত্ব। তাই চণ্ডী-তে দেবী শিবশক্তি বা বিষ্ণুশক্তি নন— স্বতন্ত্রা স্বাশ্রয়া শক্তি।
দৈত্যাধিপতি শুম্ভকে দেবী যুদ্ধে পরাজিত করার পর একাদশ অধ্যায়ে যখন ঋষিরা দেবীর স্তুতি করেছেন, তখন সেই স্তুতিতে বলা হয়েছে যে, দেবী জগতের একমাত্র আধারশক্তি। তিনি অনন্তবীর্যা, বিশ্বের বীজশক্তি। এই বীর্য একমাত্র দেবীরই শক্তি নয়, জগতের সমস্ত স্ত্রীর মধ্যেই তা বিদ্যমান। এই বীর্যশক্তির দ্বারাই নারী সমস্ত অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে পারে। তাই দেবীর কাছে পুরুষ শুধু রূপ, জয়, যশ, শত্রুবিনাশ, আরোগ্য, বিপুল ঐশ্বর্যই একমাত্র প্রার্থনা করেনি, সেই সঙ্গে প্রার্থনা জানিয়েছে ‘ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্’— আমার মনোবৃত্তির অনুসরণকারিণী মনোরমা পত্নী দাও।
চণ্ডী-তে কোথাওই দেবীকে অন্য দেবতার উপর নির্ভরশীল হিসেবে তুলে ধরা হয়নি, তাঁর নিজস্ব শক্তির গরিমার স্তুতি করা হয়েছে। এখানেই এই ধর্মগ্রন্থের বিশেষ গুরুত্ব। অন্যান্য ধর্মে যখন নারীর ভূমিকার এত দৃঢ স্বীকারোক্তি তর্কসাপেক্ষ, ওই প্রাচীনকালেই হিন্দুধর্মে পূজিতা দেবীর এই প্রাধান্যের স্বীকৃতি বিস্ময় জাগায় বইকি! তাই এটা খুবই দুঃখের যে, দেশ জুড়ে যখন আমরা দেবীপূজার মাধ্যমে এই নারীশক্তির বন্দনা করছি, তখন সেই দেশেই নারীর কত নির্যাতন করা চলছে। মৃন্ময়ী মূর্তি থাক, সংসারের সমস্ত চিন্ময়ী ‘দুর্গা’র শক্তি স্বীকার করাই হবে প্রকৃত মন্ত্রোচ্চারণ, সত্যিকারের পুজো।
দর্শন বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়