পরীক্ষার্থী: নাগরিকত্ব প্রমাণ করার পদ্ধতিটি এত জটিল যে বহু নাগরিকই তা প্রমাণ করে উঠতে পারেননি, বলছে অসমের শাসক দলই। এএফপি
অসমের ১৯ লক্ষ বাসিন্দা। মানে, সে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। শনিবার থেকে তাঁরা আর ‘ভারতীয়’ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নন। তাঁদের নাম নাগরিক পঞ্জিতে ওঠেনি। এর পর তাঁদের কাজ, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল-এর কাছে গিয়ে আবেদন করা। সেই আবেদনে ফল হওয়ার সম্ভাবনা অল্পই। আর ফল না হলে কিছুই করার নেই। তাঁদের পাঠানো হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে, যাকে বাংলায় বন্দিশিবির বলা যেতে পারে। সেই শিবিরে পুরুষ-নারী আলাদা করে দেওয়া হবে। নামকাটা মানুষদের বাড়ি থেকে, পরিবার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্ধারিত ক্যাম্পে পুরে দেওয়া হবে। স্বামীর থেকে স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হবেন। বৃদ্ধ পিতামাতা সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন। শিশুরা পিতামাতার আশ্রয় ছেড়ে ক্যাম্পে যেতে বাধ্য হবে। নাম বেরোনোর আগেই এ সব ভেবে কত মানুষ আত্মহত্যা করছেন, কত মানুষ পাগল হতে বসেছেন, সে সব খবর আমরা কেউ কেউ জেনেছি।
কিন্তু জানা আর বোঝা এক জিনিস না। তাই, ভারতের যে অল্পসংখ্যক লোক এ সব জেনেছি, তারাও তার পর ঠান্ডা মাথায় প্রশান্ত মুখে নিজ নিজ কাজে ফিরে গিয়েছি। কাশ্মীরের পর আবার অসম নিয়ে ভাবতে হবে ভেবেই বেশ ক্লান্ত বোধ করেছি। উইকএন্ড পড়েছে মাঝে, সময়ও বেশি পাইনি।
এই যে শান্ত, নিশ্চিন্ত আমরা, এর জন্য আলাদা করে একটা হাততালি প্রাপ্য আমাদের শাসকদের। কী দারুণ দক্ষতায় আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে সহ্যক্ষমতা বাড়ানোর ওষুধ ‘ইনজেক্ট’ করা হচ্ছে। যাতে আমরা বুঝতেই না পারি, ঠিক কী কী ঘটে যাচ্ছে আমাদের দেশে। ভারত ভূখণ্ডটা কেমন নিজেকে পাল্টে ফেলছে। এনআরসি-র মতো আসুরিক প্রক্রিয়া প্রথম বার ঘটিয়ে ফেলল এ দেশ, তবু আমরা কেমন নিস্তরঙ্গ। বড় রাস্তায় ছুটতে ছুটতে গাড়ি আচমকা একটা তীক্ষ্ণ ইউ-টার্ন নিল অথচ যাত্রিসাধারণ অবাক হল না— ব্যাপারটা তেমনই।
এই অসহনীয় সহ্যপরায়ণতা কাটিয়ে আমরা জেগে উঠতে পারব, এত আশা করি না। তবু কয়েকটা জিনিস এই বেলা বলে রাখা ভাল। এই যেমন, অসমের অধিবাসীদের দশকব্যাপী ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে অসমে এ বার যা ঘটল, এটা কিন্তু কেবল দেশের একটা অংশের বিষয় হিসেবে পাশে সরিয়ে রাখা প্রচণ্ড বোকামি হবে। এ দেশের বর্তমান শাসকের যে ‘আজেন্ডা’, তা পূরণ করার চেষ্টাটাই অসমের এনআরসি-র মূল লক্ষ্য। আর তাই, সারা ভারতের জন্যই এনআরসি-র একটা বিরাট অর্থ আছে। সেটা ভাল করে হৃদয়ঙ্গম করা দরকার।
অসমে ‘ভূমিপুত্র বনাম বাঙালি’ অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়ে রয়েছে অনেক দিন ধরে, দেশভাগেরও আগে থেকে। দেশভাগের পর সীমান্ত পেরিয়ে আসা জনস্রোতের ধাক্কায় সেই অশান্তি লাফিয়ে বেড়েছে। কিন্তু সেই অশান্তির অভিমুখ থেকেছে ‘বাঙালি’র দিকে। এ দিকে রাজ্য বিজেপি ও কেন্দ্রীয় বিজেপি কিন্তু এ বার উঠেপড়ে লেগেছিল, অভিমুখটাকে ধাক্কা দিয়ে বাঙালি থেকে ‘বাঙালি মুসলিম’-এর দিকে ঘুরিয়ে দিতে। ঠিক এই জন্যই এনআরসি চালু হওয়ার পর পরই লোকসভায় সিটিজ়েনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল বা ‘ক্যাব’, বা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলটিও আনা হয়েছিল। এই বিলে সম্পূর্ণ অ-সাংবিধানিক ভাবে মুসলিমদের বাদ দিয়ে বাকি সব ধর্মীয় পরিচয়ের লোকদের নাগরিকত্ব প্রদান করার বন্দোবস্ত দেখা গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে প্রতিবেশী দেশে নির্যাতিত হন যাঁরা, তাঁরা ‘শরণার্থী’, ভারত তাঁদের আশ্রয় দেবে। আর বাকিরা ‘অনুপ্রবেশকারী’, তাঁদের এ দেশ আশ্রয় দেবে না।
শরণার্থী-অনুপ্রবেশকারীর ভাগাভাগিটা কষার আর একটা বিচিত্র উপায় দেখা গেল ‘ক্যাব’-এ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আগত মানুষদের মধ্যে শরণার্থী-অনুপ্রবেশকারী দুই গোত্রের কথা বলা হল— যদিও আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ সীমান্তরেখা নেই! আর প্রত্যক্ষ সীমান্তরেখা আছে, এমন একটি দেশ মায়ানমারকে তালিকা থেকে স্রেফ বাদ দেওয়া হল, যাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নির্যাতিত, এই দ্বৈত পরিচয়ে মুসলিমরা এ দেশে আশ্রয় চাইতে না পারেন।
জলের মতো পরিষ্কার। মুসলিমদের ভারতে অ-নাগরিক বা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে দেওয়া: গোলওয়ালকর-সাভারকরের এই আদি-তত্ত্বকে কাজে পরিণত করাই নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় দফার শাসনের প্রধান কর্মসূচি। এমন যৌথ জালের ব্যবস্থা সেই কারণেই— একটি জালে বৈধ কাগজ না দেখাতে-পারা সকলকেই ধরা হবে (এনআরসি), আর একটি জালে কাগজ না দেখাতে পারলেও হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-পার্সি-খ্রিস্টান ইত্যাদিদের শরণার্থী বলে বাঁচিয়ে দেওয়া যাবে (ক্যাব)। দুই জালের ফাঁক দিয়ে গলে নীচে তলিয়ে যাবেন সমস্ত মুসলমান। তাঁরা প্রতিপন্ন হবেন ‘অ-নাগরিক’ হিসেবে। ভারতের সংবিধান যদিও বলছে, এ দেশের আইন ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রযুক্ত হতে পারে না, তাতে কী এসে যায়। তা ছাড়া, আইন পাল্টাতেই বা কত ক্ষণ। কাশ্মীরের তিনশো সত্তর ধারাই তো দেখিয়ে দিয়েছে, ২০১৯ সালের মে-র পর দেশের আইনসভা এক তুড়িতে আইন পাল্টাতে পারে। এ বার অন্যান্য প্রদেশেও এনআরসি হবে, বলে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, তিনশো সত্তর, এনআরসি— এই কয়েকটি ‘বিশেষ’ কাজের জন্যই এই পদ নিয়েছেন অমিত শাহ, এমন অনুমানও ভুল হবে না নিশ্চয়।
এ দিকে কাণ্ড— বিজেপির শত প্রয়াস সত্ত্বেও দেখা গেল এনআরসি-র জালে ধরা পড়ল এক বিরাটসংখ্যক হিন্দু। নিজেদের ভোটাররাই অনাগরিক হয়ে গেলে নেতাদের মুখ থাকে কী করে! ক্যাব নামক জালটি এখনও হাতে রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে এত মানুষকে বাঁচানো কঠিন নয় কি? তাই এত দিন ধরে এনআরসি-এনআরসি করে লাফানোর পর গত কয়েক সপ্তাহে হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার মুখে হঠাৎ শোনা গেল, ‘‘এনআরসি-র উপর আমরা আশা হারিয়ে ফেলেছি।’’ সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেও ফল হল না। তালিকা ৩১ অগস্ট বেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তাঁদের মুখে হুমকি: ‘অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিতকরণ চলবেই, থামবে না! বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব যুক্তি দিয়েছেন: এনআরসি বলেছিল এ দেশে জন্মানোর প্রমাণ দিতে, তা হিন্দুরা তো ভারতেই জন্মাবেন, জেরুসালেম বা আমেরিকাতে তো জন্মাবেন না! ‘বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান তো ভারতবর্ষ থেকেই তৈরি।’ চমৎকার! সীমানা পেরোনো মুসলিমরা অনুপ্রবেশকারী, কেননা বাংলাদেশ প্রতিবেশী মুসলিম দেশ। আর, সীমানা পেরোনো হিন্দুরা শরণার্থী, কেননা বাংলাদেশ ভারত থেকে তৈরি আর একটি দেশ বই কিছু নয়।
এই নির্জলা স্ববিরোধিতা বিজেপিকে ঝামেলায় ফেলতে শুরু করেছে অন্য দিক দিয়েও। শনিবারের পর থেকে অসম বিজেপি বলছে, এনআরসি অত্যন্ত গোলমেলে ব্যাপার। এ দিকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি এনআরসি-র প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কেননা বাংলাদেশ সীমান্ত এই রাজ্যেও বিরাট লম্বা, এখানকার হিন্দু ভোট টানার জন্যও এনআরসি কার্ড বিজেপির দরকার। প্রসঙ্গত, আরও দু’টি রাজ্যে বিজেপির মুখে এনআরসি-র কথা আজকাল খুব শোনা যাচ্ছে। দু’টিই বিরোধী-শাসিত, তেলঙ্গানা ও দিল্লি! মনে হয়, দ্রুত কেন্দ্রীয় স্তরে তাঁদের ভাবা দরকার, ‘টু বি অর নট টু বি’র আদলে: এনআরসি, না কি নো-এনআরসি।
ভাবা দরকার ভারতীয় সমাজেরও। এনআরসি এবং ক্যাব-এর এই মুসলিম-ধরা ফাঁদ যখন দেশের অন্যত্রও ফেলা হবে, অসমের মতোই তাতে আটকে যেতে পারেন অমুসলিমরাও। ভারতের হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে-ওঠার সুখস্বপ্নে বিভোর মানুষদের কে কোথায় সেই প্রেমফাঁদে ধরা পড়বেন কে বলতে পারে।
আর, যাঁরা আজও মনে করেন ধর্মপরিচয় দিয়ে নাগরিকত্ব পরীক্ষার চেষ্টা যে দেশ করে, তেমন দেশের বাসিন্দা হতে তাঁরা চাননি, চান না— নিজ নিজ কাজের ফাঁকে কষ্টেসৃষ্টে তাঁরা একটু সময় করে উঠতে পারবেন কি? তা হলে এক বার ভেবে নিতে পারেন: কোনও গণতান্ত্রিক দেশ কি এই ভাবে তার সমস্ত বাসিন্দাকে নাগরিকত্বের পরীক্ষায় বসিয়ে দিতে পারে? তুমি নাগরিক কি না, তা প্রমাণ করার ভার কি কেবল তোমারই উপর? রাষ্ট্রের কোনও দায় নেই? দীর্ঘ সময় ধরে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসছে এত মানুষ, সীমান্তরক্ষী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা সবাই তাতে প্রাণপণ আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন, সব রকম সহযোগিতা করছেন, অথচ সেই সম্মিলিত অনাচারের শাস্তি কেবল সীমান্ত-পেরোনো গরিবদুঃখী মানুষগুলোর উপরই বর্ষিত হবে? অসহায়তম পক্ষটিকে এ ভাবে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়ার পদ্ধতিতে সায় দিয়েই আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করে যাব? আমাদের এই অপরিসীম সহ্যক্ষমতা গণতন্ত্রের ধর্মে সইবে তো?