—প্রতীকী ছবি
জনতা যে নেতাকে বাছিয়া লইয়া প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিনিধি-সভায় পাঠান, তিনি কি তাঁহার দলের নিকট দায়বদ্ধ, না কি জনতার নিকট? না কি নিজেরই নিকট, সর্বাগ্রে? প্রশ্নটি শুনিতে দার্শনিক। তবে বাস্তব দেখাইয়া দিতেছে, দর্শনভাবনা যাঁহাদের ধাতেও নাই, তাঁহারাই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হন সর্বাপেক্ষা বেশি। এই মুহূর্তে আমেরিকায় রিপাবলিকান পার্টির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হাউস অব কংগ্রেস ও সেনেট-এ বসিয়া বিবেচনা করিতেছেন, তাঁহারা কি দলের মুখ চাহিয়া বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায় সায় দিয়া চলিবেন, না কি নিজেদের বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত লইবেন? দ্বিতীয় দিকেই যে পাল্লা ঝুঁকিতেছে, তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ: এক, নির্বাচনী ফল লইয়া তদন্ত চালাইবার ব্যাপারে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে রিপাবলিকান নেতাদের অসহযোগ ও অসম্মতিদান। এবং দুই, ট্রাম্পের ভিটো-য় আটকাইয়া পড়া বিরাট অঙ্কের জাতীয় প্রতিরক্ষা স্বীকৃতি আইনটির (ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজ়েশন অ্যাক্ট) বিষয়ে ট্রাম্পীয় ভিটো-কে অতিক্রম করিয়া স্বীকৃতিদান। অর্থাৎ এত দিন তাঁহারা ট্রাম্পের সঙ্গে সর্ব বিষয়ে একমত পোষণ না করিলেও দলের নীতি বলিতে দলের পরিচয়ে পরিচিত প্রেসিডেন্টের নীতিই মানিয়া লইতেন। আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের মতকে তাঁহারা উদ্ধার করিতেছেন। শুনিয়া মন্দ লাগে না। গণতন্ত্রের উদ্ধার বলিয়া মনে হয়। গণতন্ত্র তো মুক্ত বিবেচনায় চলিবারই ব্যবস্থা। দল বা নেতা, কাহারও অঙ্গুলিহেলনে চলিবার জন্য তো এই ‘সিস্টেম’ তৈরি হয় নাই।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি একটি ছোট্ট ঘটনা ঘটিয়া গেল কেরলে। কেন্দ্রের কৃষি আইন প্রত্যাহার দাবি করিয়া একটি প্রস্তাব পাশ করিল কেরল বিধানসভা, তাহাতে ‘সম্মতি’ দিলেন বিজেপি বিধায়কও। বর্ষীয়ান বিজেপি বিধায়ক বলিলেন, এই আইনের অনেক দিক তাঁহার পছন্দ নহে। এই ঘটনাকে তাহার উপরিতলের বিবরণেই খোলসা করিয়া বুঝিবার উপায় নাই, তবে কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসক দল যখন সংখ্যার প্রবল প্রতাপে আর সব কিছুকে পিষ্ট করে, তখন একটি ব্যক্তি-কণ্ঠও গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠে।
এবং এইখানেই আসিয়া দাঁড়ায় এক বিষম সঙ্কট। দলমতের বুলডোজ়ারে সব রকম কণ্ঠ শিয়ালরবে পরিণত হওয়া গণতন্ত্রের অবমাননা, ‘গণ’-র বদলে উহা ‘দল’-এর তন্ত্র, ইহা জানা কথা। ইস্যুভিত্তিক ভাবে ব্যক্তি-প্রতিনিধির নিজস্ব মত শুনিতে পাইলে তাহা সুসংবাদই হইবার কথা। স্মরণীয়, এই আশ্বাসবাচক ‘বিবেক-ভোট’ বস্তুটি দলীয় রাজনীতিকে বিপন্ন করে বলিয়াই দলব্যবস্থা দলীয় হুইপ জারির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়া থাকে। কিন্তু ব্যক্তি-কণ্ঠের নামে যদি ছদ্মবেশে মঞ্চে নামে অপর পক্ষের দলতন্ত্র? যদি ব্যক্তিকে ‘ভাঙাইয়া’ লইবার খেলা চলে নেপথ্যে? পশ্চিমবঙ্গের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিধায়ক নিজের দলে থাকিতে থাকিতেই দল হইতে দূরত্ব রচনা করিয়াছিলেন বিধানসভার ভিতরে ও বাহিরে— তাহাকে কি ‘ব্যক্তি-কণ্ঠ’ বা ‘বিবেক-আহ্বান’ বলিয়া ভুল করিবার সামান্যতম অবকাশও থাকিতে পারে? তাহা তো কেবলই রাজনীতির সঙ্কীর্ণ স্বার্থ। ভিতরে বাহিরে স্বার্থের কুৎসিত খেলায় ব্যক্তি আর ব্যক্তি থাকেন না— স্বার্থসন্ধান ও আত্মসর্বস্বতার অবয়ব হইয়া উঠেন। গণতন্ত্র এক হাতে তাহার আশার নবধান্য ছড়াইয়া যায়, অন্য হাতে বিষের বীজ বপন করে।