আর, নাগরিক মুসলিমরা?

একটা আতঙ্ক সর্বক্ষণ তাড়া করছে। টিভি, কাগজ, নেতা, মানুষের নিরন্তর চর্চায় এখন‌ এনআরসি, এনপিআর, ভোটারের তথ্য যাচাই, ডিজিটাল রেশন কার্ড, রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোজন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল।

Advertisement

শহীদুল ইসলাম

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share:

বীরভূম জেলার মুরারই গ্রামে ১৯৫৯ সালে আমার জন্ম। সেখানকার ধুলো-কাদা মেখে বেড়ে ওঠা। গ্রীষ্ম, বর্ষা, সর্বদাই ধানখেতের আলপথ ধরে স্কুলে যাওয়া। আমার দাদু দীর্ঘ দিন গ্রাম পঞ্চায়েতের সভাপতি ছিলেন। দশ-বারো মাইল কাঁচা রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে বাবা গিয়েছেন প্রাথমিক স্কুলে। আর মা? পল্লিবধূ জানতেন না দেশভাগ কী। শুধু বলতেন, এই মাটিতেই যেন তাঁকে কবর দেওয়া হয়। মাকে এই মাটিতেই কবর দিয়েছি।

Advertisement

অথচ আজ একটা আতঙ্ক সর্বক্ষণ তাড়া করছে। টিভি, কাগজ, নেতা, মানুষের নিরন্তর চর্চায় এখন‌ এনআরসি, এনপিআর, ভোটারের তথ্য যাচাই, ডিজিটাল রেশন কার্ড, রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোজন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে তরজা এমন উচ্চতায় উঠছে যে আত্মহত্যা বেছে নিচ্ছেন এই মাটিরই মানুষ। এর দায় এড়াতে পারে না কেন্দ্র, রাজ্য, রাজনৈতিক দলগুলো।

গত লোকসভা ভোটের আগে অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রস্তুতির সময় (২২ জুলাই, ২০১৮) তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দেন, প্রতিটি নাগরিকের প্রতি মানবিক আচরণ এবং সুবিচার তাঁরা নিশ্চিত করতে চান। আতঙ্কের কারণ নেই। রাজনৈতিক ভাষ্য ঠিক উল্টো। বিজেপি এবং তার শরিক দলের নেতারা বলতে শুরু করলেন, এনআরসি করে গোটা দেশ থেকে মুসলিম তাড়াব। ক’জন বলছেন ‘অনুপ্রবেশকারী’‌ মুসলমান তাড়াব? একই দলের সরকার এবং নেতাদের আলাদা আলাদা বক্তব্য কি বিভ্রান্তি তৈরি করার পক্ষে যথেষ্ট নয়?‌ আমার আতঙ্ক, আমি কোন দলে?‌ সাচ্চা নাগরিক না অনুপ্রবেশকারী?‌ অনুপ্রবেশকারী নয়, এটা প্রমাণ দিতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি অসমের বাসিন্দাদের। নাগরিকত্বের যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নানা অজুহাতে আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে জন্মভূমি থেকে বার করে দেওয়া হতে পারে।

Advertisement

বিজেপির বিপুল গরিষ্ঠতা লোকসভায়। এখন রাজ্যসভাতেও কোনও সংশয় নেই। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সহজেই পাশ হবে, যাতে রয়েছে ভয়ঙ্কর দ্বিজাতিতত্ত্বের ছায়া। সম্প্রতি জ্বলন্ত কাঠে ঘি ছড়ালেন অমিত শাহ। কলকাতায় এসে বলে গেলেন, নাগরিকত্ব বিল কার্যকর করেই এনআরসি করা হবে। দলীয় কর্মীদের এটাই প্রচার করতে বললেন। দেশভাগের সময় আমার মতো কোটি কোটি মুসলিমের‌ পূর্বপুরুষরা তো হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্যই এ দেশ ছেড়ে যাননি। তাঁদের ত্রুটি কোথায়?‌

কেন্দ্রের ঘোষণামতো, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ‌পর্যন্ত সারা দেশে চলবে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রেশনের (এনপিআর)‌ কাজ। সেখানেও নাকি একদফা ঝাড়াইবাছাই হবে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, এটা রুটিনমাফিক কাজ। তবু গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত মানুষ হুড়োহুড়ি করে বাক্স–পেটরা, সিন্দুক খুঁজছেন। যদি বা দলিলপত্র মেলে, তাতে নিজের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা নির্ভুল কি না জানতে ছুটোছুটির শেষ নেই তাঁদের। অনেকের কোনও কাগজই নেই। নাগরিকত্ব প্রমাণে সাহায্য করতে পারে, এই ভেবে ডিজিটাল রেশন কার্ড করাতে রোজ লক্ষ লক্ষ মানুষ লাইন দিচ্ছেন। এরই মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর রাজ্য খাদ্য দফতর নির্দেশ দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে রেশন কার্ডের আধার-সংযুক্তি করতে হবে। যে মমতা আধারের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁর সরকারই আধার-সংযুক্তির কথা বলছে। তা হলে আগ বাড়িয়ে সমালোচনা করলেন কেন?

মমতা বলছেন পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হতে দেবেন না। ১৯ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পর মমতা জানিয়ে দিলেন, শাহ পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি সম্পর্কে কথা বলেননি। সেখানে এনআরসি দরকার নেই। মমতার এই বক্তব্যের সারবত্তাও রয়েছে। এনআরসি-র প্রস্তাব তো রাজ্য বিধানসভায় প্রথমে পাশ করাতে হবে। সেটা তৃণমূল সরকার থাকাকালীন সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই বিধানসভায় এনআরসি-র বিপক্ষে বিজেপি বাদে সর্বদলীয় প্রস্তাবও পাশ হয়েছে। আমরা আশ্বস্ত হচ্ছি। কিন্তু রাঁচীতে অমিত শাহ বলেছেন, শুধু অসমে নয়, গোটা দেশে এনআরসি চালু হবে। এই চাপানউতোর বিভ্রান্তির পক্ষে যথেষ্ট নয় কি?‌ সেখান থেকেই তো এত আতঙ্কের জন্ম।

আর একটা প্রশ্নও থাকছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রাজ্যে না হয় এনআরসি ঠেকানো গেল। লোকসভায় এবং বিধানসভায় মমতা কি পারবেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আটকাতে? যার মধ্যে লুকিয়ে আছে এনআরসি-র অন্য এক ‘‌ভয়ঙ্কর’‌ রূপ যা বিজেপি নেতাদের রাজনৈতিক ভাষ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেস-সহ সমস্ত বিরোধী দলের প্রতিবাদও ধোপে টিকবে না।

দেশভাগের পর যাঁরা ভারত ছেড়ে যাননি, ১৯৫৫ সালের ভারতের নাগরিকত্ব আইনের সূত্র মেনে, তাঁদের উত্তরসূরিদের নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা‌ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে মুসলিমদের জন্য একটা বাক্যও খরচ করা হয়নি। অর্থাৎ ২০১৪ সালের আগে ভারতে আসা মুসলিমরা শরণার্থী হিসেবে গণ্য হবেন না, এমনই ধরে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে আমরা যাঁরা ‘‌নাগরিক’‌ মুসলিম, তাঁদের গায়ে আঁচ লাগাটা কি স্বাভাবিক নয়?‌ তখন বিশ্বভ্রাতৃত্বের সুতোয় ধর্মনিরপেক্ষতার জিগির তোলাও কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে?

আশা করি, এ আতঙ্ক দূর করার জন্য সহমর্মী মানুষের অভাব হবে না আমাদের ভারতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement