Tamil Nadu

কেমন হবে পদবি-মুক্ত জীবন

অনেকেই পদবিকে অস্বীকারের স্পর্ধা দেখাচ্ছেন। ‘পাত্রপাত্রী’-র বিজ্ঞাপন থেকে প্রেম—পদবির কম্বিনেশন বেশ কিছু ক্ষেত্রে জাতপাতকেও অস্বীকার করে।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২০ ১০:০৫
Share:

তামিলনাড়ুর মেয়ে স্নেহা ভারতের প্রথম ‘ধর্মহীন নাগরিক’-এর মর্যাদা লাভ করেছেন।

বন্ধুর ফ্ল্যাটের নীচে নিরাপত্তারক্ষী গৌরদা বসে থাকতেন। শীর্ণ চেহারা, প্রৌঢ় মানুষ। মায়া লাগত, মজাও লাগত একটু। যদি কোনও পেশিয়াল ব্যক্তি অন্যায় করেন, গৌরদা ঠেকাতে পারবেন? বন্ধু তাঁকে চা খাওয়াত। উনি অল্প হাসিতে কৃতজ্ঞতা জানাতেন। এক দিন এ হেন গৌরদার নামের সঙ্গে ‘আলি’ যুক্ত জেনে আমি অবাক। কেন অবাক? ‘গৌর’ নামটির কারণে? শীর্ণ, বিনয়ী চেহারার জন্য? তা হলে বিশেষ শ্রেণির ক্ষেত্রে বিশেষ নাম, বিশেষ চেহারা বা আচরণ কি প্রত্যাশার গভীরে থেকে গিয়েছে? ‘আলি’ শব্দটি কানে না এলে, গৌরদা কি সেই চেনা মানুষটিই থেকে যেতেন?

Advertisement

অনেকেই পদবিকে অস্বীকারের স্পর্ধা দেখাচ্ছেন। ‘পাত্রপাত্রী’-র বিজ্ঞাপন থেকে প্রেম—পদবির কম্বিনেশন বেশ কিছু ক্ষেত্রে জাতপাতকেও অস্বীকার করে। এই দেশেই অম্বেডকরের মতো মেধাবী ছাত্রকে লেখাপড়ার খাতিরে, ‘দলিত’ পরিচয় লুকাতে শিক্ষকের পদবি ধার করতে হয়েছিল। কাজেই দু’-এক জন প্রগতিশীল মানুষের ‘অসবর্ণ’ বিবাহ আমাদের উৎসাহিতই করে। প্রশ্ন উঠছে, তাঁরা নিজের পদবিটি তা হলে এত দিন ব্যবহার করেছেন কেন? এ নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু পদবি ব্যবহার না করায়, এই দেশে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে হয়রানি হয়েছে, সেই দৃষ্টান্তও রয়েছে।

তামিলনাড়ুর মেয়ে স্নেহা (ছবিতে) ভারতের প্রথম ‘ধর্মহীন নাগরিক’-এর মর্যাদা লাভ করেছেন। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, নাস্তিকতা এখানে ‘অপরাধ’ নয়। স্নেহা আইনজীবী। তবু ‘ধর্মহীন’ হতে লড়েছেন ন’বছর। কাজেই পদবি নিয়ে সংস্কারমুক্তি যাঁর বাসনা, তাঁর সামনে ‘বর্ণ’ পরিচয় মুক্ত হওয়ার সহজ পথ এ দেশে নেই। বহু দেশেই চিত্রটি এমনই।

Advertisement

নিজের পদবি নিজে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা মানুষ চাইতে পারেন, কিন্তু মনে হয় এতে জটিলতা বাড়বে। কারণ, ১০০ কোটি নাগরিকের দেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে তা নথিবদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। জন্মের শংসাপত্রে যদি পদবি উল্লেখ না করা হয়, তা হলে সেই পদবি থেকে মুক্ত হওয়ার আর প্রশ্নই উঠবে না। অনেকেই চান, সন্তানের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ সুগম হোক। সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে স্বেচ্ছায় পদবি বেছে নিতে পারে, না-ও পারে। যে দেশে ফ্রিজে কিসের মাংস আছে, না জেনে শুধু সন্দেহের বশে মানুষ খুন হয়, সেই দেশে এই নিয়ম চালু করাও সদর্থক হবে কি না বলা মুশকিল।

আর এক শ্রেণির নাগরিক সার্বিক ভাবেই পদবি প্রথার আগ্রাসনের ক্ষতি বইছেন। হ্যাঁ, মেয়েরা। তাঁদের নিজের ভূমিকাও সেখানে কম নেই। পদবি বংশ রক্ষা করে। পুত্রসন্তান কামনায় স্ত্রী, কন্যাকে যাতনা দেওয়ার এও একটি কারণ। বিবাহের পর স্ত্রী ‘স্বামী’র পদবি পান। উল্টোটা হয় না। অবশ্য অনেক মেয়ে আজকাল নিজের পদবি বজায় রাখেন। অনেকে দু’টি পদবিই নিয়ে চলেন ভারিক্কি চালে। এতে ব্যাঙ্ক বা অন্য ক্ষেত্রে অনেক অসুবিধা। ‘পুরুষতন্ত্র’, ‘জাতিভেদ’ ইত্যাদির বিষ তো ছেলে মেয়ে উভয়কেই প্রভাবিত করেছে। জীবনসঙ্গীর চেয়ে ‘উঁচু জাত’-এর হলে, ‘অসবর্ণ বিবাহ’-এও অনেক মেয়েই পদবি বজায় রাখেন। আবার অনেক ‘কায়স্থ’ স্ত্রী ‘ব্রাহ্মণ’ বা ‘বৈদ্য’ স্বামী পেলে ‘উপাধ্যায়’ বা ‘গুপ্ত’ হওয়ার আকর্ষণ সামলাতে পারেন না। হরেদরে বৈষম্যের পতাকাই উড্ডীন থাকে।

আইন করে পদবি প্রথা তুলে দেওয়ারই সময় এসেছে। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সব ধর্মের সমান কাছে নয়, রাষ্ট্রকে থাকতে হবে সব ধর্ম থেকে সমান দূরে। যে দেশের সংবিধান ‘বৈষম্য বিরোধী’ অধিকার নাগরিকদের দিয়েছে, বৈষম্যের প্রধান সূচক পদবি সে বজায় রাখবে কেন? ধর্ম যার যার নিজের থাক। সংস্কৃতিও থাক। শুধু পদবি বাদ যাক। কারণ এখন পদবি আর কারও পেশার পরিচয় দেয় না।

বিষয়টি সহজ নয়। লিঙ্গ, ধর্ম, জাত এই সব ভোটের ময়দানে বড় খেলোয়াড়। এমনিতে স্বামীর পদবি ব্যবহার করলেও ‘বাবার মেয়ে’ হিসাবে ভোট চাইতে গিয়ে অনেক নেত্রীই বাবার পদবি ব্যবহার করছেন। পদবি প্রথা উঠে গেলে রাজনীতির অসুবিধা। মৌলবাদীর অসুবিধা। মানবাধিকার, সংস্কার, শাস্ত্র, সংস্কৃতির প্রশ্ন উঠবে। তবু আলোচনাটা উঠুক। ‘বংশ’ যদি প্রতিভা, পেশা বা মানসিকতার বদলে ‘পদবি’-র নৌকায় কালের ঘাট পেরোতে চায়, তবে ‘পদবি’ বিলুপ্ত হোক৷ অনেক প্রাণই তা হলে ভ্রূণ অবস্থা থেকে শরীর লাভ করবে।

পদবির ভার লাঘব হলে বৈষম্যহীন পৃথিবীতে আর একটু হালকা পায়ে এগোনো যাবে। পদবি কেন দরকার, সমনামী মানুষকে পৃথক ভাবে চিনতে পদবির ভূমিকা: আলোচনা হবে। তরুণদের মধ্যে পদবিহীন বিশ্বের ভাবনাটা জোরদার হবে। এক জন বিদ্যাসাগর বা বেগম রোকেয়া আসবেন সেই ভবিষ্যৎ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে। ছাত্রছাত্রীদের মনে তার বীজ উপ্ত হোক!

এই প্রাবন্ধিকও নিজের পদবি অন্তত তাঁর লেখার ক্ষেত্রে বাদ দিতেই পারতেন। বদলে তিনি সেই দিনের অপেক্ষায় রইলেন, পদবি বিষয়টিই যে দিন আর থাকবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement