শিক্ষা হোক এমন, যা খুলবে মনের দোর

আদর্শ শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত? টিউশন-নির্ভর শিক্ষা কি পড়ুয়াকে পরিপূর্ণতা দিতে পারে? তাতে তোতাপাখির মতো মুখস্থ করা ছাড়া আর কিছু হয় কি? বরং পাঁচটা বই ঘেঁটে, ইন্টারনেট খুঁজে উত্তর লিখে কেউ পরিপূর্ণতার স্বাদ পেতে পারে। সেই অভ্যাস তৈরি হওয়া দরকার। লিখছেন পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়।আদর্শ শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত? টিউশন-নির্ভর শিক্ষা কি পড়ুয়াকে পরিপূর্ণতা দিতে পারে? তাতে তোতাপাখির মতো মুখস্থ করা ছাড়া আর কিছু হয় কি? বরং পাঁচটা বই ঘেঁটে, ইন্টারনেট খুঁজে উত্তর লিখে কেউ পরিপূর্ণতার স্বাদ পেতে পারে। সেই অভ্যাস তৈরি হওয়া দরকার। লিখছেন পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৩০
Share:

বন্দি: স্কুল থেকে ফেরার পথে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

এখন দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যতের স্বর্ণাভ-স্বপ্ন ধাক্কা খাচ্ছে ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি না থাকায়। ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’—আপ্তবাক্যটি নিশ্চয় ভাল, কিন্তু জীবনে অন্তত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আনতে এমনকি, উচ্চ প্রাথমিক স্তরও আবশ্যিক না-করে, শুধুমাত্র চিহ্নভিত্তিক উত্তরকে মেধার মানদণ্ড হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশাল এক ফাঁপা মানবসম্পদ তৈরি হয়েছে। শিক্ষক হয়েও ইংরেজি ভাষা শুদ্ধভাবে না লেখার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দেখা যায়। স্বাভাবিক ভাবেই জীবনের পরবর্তী ক্ষেত্রে ইংরেজিতে সাফল্য আনতে ভীষণ কষ্ট হয়। এখানে জীবন ও জীবিকার মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান থাকছে।

Advertisement

এখন অধিকাংশ শিক্ষার্থী চায়—অল্প পরিশ্রমে অনেক অর্থ রোজগার। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। প্রচুর পরিশ্রমী বিদ্যার্থীও আছে। তারা জীবনসংগ্রামে নেমে খুবই পরিশ্রম করে। তাদের প্রয়োজন ইংরেজিতে বাক্যালাপে সাবলীলতা আনা। কারিগরি বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যায় ছাত্রেরা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ বিদ্যার্থীরা ভাষার প্রয়োগশক্তির অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। এখন আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমে পড়ানো হচ্ছে ক্লাসরুমে। চল্লিশ বছর আগে উত্তীর্ণ শিক্ষককুল (অবশ্যই সকলে নন) স্বভাবতই ইংরেজি বলা-কওয়ায় বিশেষ সাবলীল নন। এই জন্যই কালে কালে সমাজে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল এত গড়ে উঠছে। চাহিদা বাড়ছে। সমাজে শিক্ষার দ্বিবিধ ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এই ব্যবস্থা সুখকর নয়।

এখন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে বহিরাগত শক্তি। রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী থেকে কাজ করা এক জিনিস, আর পেশিশক্তির প্রয়োগে যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতায় থাকা আর এক জিনিস। এই দ্বিতীয় অশুভ প্রবণতাটি শুরু হয়েছে এই শতকের প্রথম দিকে। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত না করতে পারলে মেঘমুক্ত নির্মল শিক্ষাঙ্গন পাওয়া অসম্ভব।

Advertisement

শিক্ষার্থীদের বড় অংশেরই এখন লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ার অভ্যাস কম। বৈদ্যুতিন ব্যবস্থায় মাউসে ক্লিক করেই এখন সব গ্রন্থরাজির পাঠ সম্ভব। শিক্ষার্থী এটাই চায়। অনলাইন ব্যবস্থা এখন সমাজের মজ্জাগত। শহরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তবুও বা এই ব্যবস্থা সাবলীল ভাবে চললেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিবিধ সমস্যায় ভুগছে। এই বৈপরীত্য কিন্তু একটি নতুন ব্যবস্থা সফল ভাবে কার্যকর করার পথে অন্তরায়। এই বৈষম্য থেকে অচিরেই মুক্তি প্রয়োজন—অবশ্যই সমাজকল্যাণের স্বার্থে।

শিক্ষার্থীরা চায়, একটা কিছু পাশ করার পরে আর্থিক সুরক্ষা। তার জন্য নানা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু, কোর্ট-কাছারি সংক্রান্ত অনিবার্য সমস্যা এই ব্যবস্থার সফল প্রয়োগে বাধা দিচ্ছে। এর মুক্তির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন প্রত্যেকের মুক্ত, সফল মনের প্রকাশ। মানুষ যদি আত্মচৈতন্যের বৃন্তে বিশ্বচৈতন্যের পদধ্বনি না-শুনতে পায়, তা হলে সঙ্কীর্ণতা, স্বার্থপরতার জন্ম হবে। ভেদাভেদের তীব্র বেড়াজাল সমাজের অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে। শিক্ষামুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস এনে দেয়। সেখানে বিশুদ্ধ অক্সিজেন না ঢুকতে পারলে সর্বনাশ। শিক্ষাকে সত্যি সত্যি মানুষের উঠোনে নিয়ে আসতে গেলে অঞ্চল-ভিত্তিক সমীক্ষা করে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আগে স্কুলে স্কুলে কর্মশিক্ষা ছিল। ছেলেরা হাতেকলমে কাজ করত। প্রথমে এই ব্যবস্থা অনেকাংশে সফলও হয়েছিল। পরে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে আনার প্রবণতা ছাত্রছাত্রীদের মাথায় আসায় ওই ব্যবস্থা পড়ে যায়। এখানেও সেই সত্যপথ হতে বিচ্যুতিতেই এই পরিণাম।

পড়ুয়াদের ইংরেজি শিক্ষা ঠিকমতো দেওয়ার জন্য ব্যাকরণ ভিত্তিক ব্যবস্থাই শ্রেয় বলে মনে হয়। মাধ্যমিক স্তরে শুধুমাত্র টিকচিহ্ন দিয়ে নম্বর অনেক বেশি উঠতে পারে, তবে আসল শিক্ষায় অনেক ফাঁক থেকে যায়। এখন এমনকি স্নাতক উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা, বিশেষত যারা ‘মধ্যমেধা’র, বিশুদ্ধ ইংরেজি বাক্য লিখতে অসুবিধা বোধ করে। ইংরেজিতে কথা বলার অভ্যাস দরকার। না হলে পরবর্তীতে অসুবিধা কাটবে না। বিদ্যার্থীদের স্ব-চিন্তার বিকাশ খুবই জরুরি। নিজেদের মস্তিষ্কের সুস্পষ্ট প্রতিফলন না-থাকলে পড়ুয়ারা স্বাবলম্বী হতে পারে না, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হয় না। চিন্তা সুদূরপ্রসারী হয় না। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের চিন্তাজালের বিস্তার ঘটিয়েই ছাত্রছাত্রী শিক্ষার মুক্ত অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু, বর্তমানে টিউশন-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় তোতাপাখির মতো মুখস্থ করা ছাড়া আর কিছু তার হয় কি? পাঁচটা বই ঘেঁটে, ইন্টারনেট খুঁজে উত্তর লিখে কেউ পরিপূর্ণতার স্বাদ পেতে পারে। সেই অভ্যাসটা কিন্তু তৈরি হওয়া দরকার।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সম্প্রসারণে ল্যাবেরটরির উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের অর্থলগ্নি করা প্রয়োজন। যত বেশি গবেষণা হবে, তত বেশি মানবসম্পদ তৈরি হবে। তাই শিক্ষাখাতে অর্থলগ্নি একান্ত প্রয়োজন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল মাধ্যমেও পাঠদান একান্ত প্রয়োজন। এখন এ সব হচ্ছেও। বিভিন্ন স্কুলে চালু হয়েছে ‘স্মার্ট-ক্লাস’, ই-লার্নিং। তবে আরও ব্যাপক হারে হওয়া দরকার। আর দরকার উপযুক্ত সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগ। নিয়মকানুন মেনে দ্রুততার সঙ্গে যাতে শিক্ষক নিয়োগ করা যায়, তা রাষ্ট্রের দেখা দরকার। আদর্শ শিক্ষক ছাড়া পাঠদান অসম্পূর্ণ থাকে। তবে শিক্ষকদেরও আদর্শ জীবনযাপন করতে হবে। ক্লাসরুমের পাঠ ক্লাসরুমেই সম্পন্ন করতে হবে। সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার হাতছানি এড়াতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে। এমন বিষয় শিক্ষাক্রমে চালু রাখতে হবে, যা জীবিকার সন্ধান দেয়। এক কথায় পেশামুখী পড়ানোটা খুব দরকার। কারণ, জীবিকার ব্যবস্থা ভালভাবে না হলে আদর্শ শিক্ষাক্রমে কেউ আকৃষ্ট হবে না।

তবে, সবচেয়ে আগে চাই রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন। এটাই মূল। শিক্ষাঙ্গনে মুক্তমনের বিকশিত সৌরভ ছড়িয়ে না-পড়লে কিছুতেই ছাত্রছাত্রীদের সামনে আসল বিদ্যাচর্চা, আসল জ্ঞানচর্চার সিংহদুয়ার খুলবে না।

লেখক বীরভূম মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ (মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement