অশীতিপর কবি দৃশ্যত রাষ্ট্রের নিকট বিপজ্জনক। তাঁহার ভগ্নস্বাস্থ্য, তদন্তপ্রক্রিয়ায় নিরন্তর সহযোগিতা করিয়া যাওয়া, তাঁহার মুক্তির দাবিতে সমাজচিন্তকদের আবেদন— কিছুই কবি ভারাভারা রাওয়ের জামিনের জন্য যথেষ্ট হইতেছে না। যেমন, সাফুরা জ়ারগার নাম্নী জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার গবেষক— অন্তঃসত্ত্বা সাফুরার জামিনও মঞ্জুর হইতেছিল না কিছুতেই। বিনোদ দুয়া তুলনায় ভাগ্যবান, তাঁহাকে এখনও গ্রেফতার হইতে হয় নাই। প্রবীণ সাংবাদিকের অভিযোগ, পুলিশ তাঁহাকে যারপরনাই হেনস্থা করিতেছে। জানিতে চাহিতেছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন করেন কেন? এক জন মূলধারার সাংবাদিক, এক জন প্রান্তিক মানুষের কবি আর এক ছাত্রীকে এক সারিতে বসাইয়া দিয়াছে রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তাঁহাদের অবস্থান— তাঁহারা বিপজ্জনক, কারণ তাঁহারা প্রশ্ন করেন। রাষ্ট্রের চলনকে, পরিচালকদের প্রশ্ন করেন। বস্তুত, কানহাইয়া কুমার হইতে গৌরী লঙ্কেশ, যিনিই প্রশ্ন করিবার দুঃসাহস দেখাইয়াছেন, রাষ্ট্র তাঁহাকেই বিপজ্জনক জ্ঞান করিয়াছে।
বিনোদ দুয়া সুপ্রিম কোর্টে জানাইয়াছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, তাঁহার সমালোচনা করেন, কারণ এক জন সাংবাদিক হিসাবে তাহাই তাঁহার কাজ। ক্ষমতার চোখে চোখ রাখিয়া সত্য বলিতে পারা, সমালোচনা করিতে পারাই সাংবাদিকের মৌলিকতম কর্তব্য। সংবাদমাধ্যম সরকারের মহিমাকীর্তনের পরিসর নহে— তাহার জন্য পূর্বে বিজ্ঞাপন ছিল, এখন ফেসবুক-টুইটার-ইন্স্টাগ্রাম আছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে সংবাদমাধ্যমের কর্তব্য সরকারের, নেতার ভুলত্রুটি দেখাইয়া দেওয়া, সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ফলে, অখণ্ড বাক্স্বাধীনতা সাংবাদিকের মৌলিক অধিকার। অবশ্য, ভারতীয় সংবিধান শুধু সাংবাদিকদের নহে, প্রতিটি নাগরিককে এই বাক্স্বাধীনতা দিয়াছে। তাহা কি নিতান্তই বাহুল্য? না কি, ‘প্রজা’কে ‘নাগরিক’-এর মর্যাদা দিতে হইলে তাহার বাক্স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত বলিয়াই সংবিধানে এই অধিকারটি স্বীকৃত? অর্থাৎ শুধু সাংবাদিক নহে, প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার এবং কর্তব্য রাষ্ট্রক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, তাহাকে সংশোধনে বাধ্য করা। গণতন্ত্রের অনুশীলনকে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাত্যহিকতার অঙ্গ করিয়া তোলা জরুরি। গণতন্ত্রের প্রতি যে শাসনব্যবস্থার আস্থা যত কম, সেই শাসকরা তত বেশি করিয়া নাগরিককে প্রজায় পর্যবসিত করিতে চাহেন। ভারাভারা রাও বা বিনোদ দুয়ারা সেই প্রক্রিয়ার পথে বড় বাধা। ফলে, রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বশক্তিতে তাঁহাদের কণ্ঠরোধ করিতে চাহে। ইহাকে ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অন্যায় বলিলে খণ্ডদর্শন হইবে— ইহা গণতান্ত্রিকতার সহিত সর্বাধিপত্যকামী শাসনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব।
ভারাভারা রাও, বিনোদ দুয়াদের অবস্থা দেখিলে নাগরিকদের মনে ভীতির সঞ্চার হইতে পারে— শাসকদের প্রশ্ন করিবার পরিণতি ভয়ঙ্কর। আশঙ্কা হয়, সেই ভীতিটিকে সর্বজনীন করিয়া তোলাই শাসকদের লক্ষ্য। কিন্তু, ভীতিটি যে একতরফা নহে, তাহাও একই রকম স্পষ্ট। এক অশীতিপর বৃদ্ধের কবিতাকে, তাঁহার বক্তৃতাকে রাষ্ট্র ভয় পায়; সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্যত একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিবার পরও সাংবাদিকের প্রশ্নের সম্মুখে নেতারা অস্বস্তিতে পড়েন; এক অন্তঃসত্ত্বা তরুণীর মুষ্টিবদ্ধ হাত কর্তাদের রাতের ঘুম কাড়িয়া লইতে পারে; বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের স্লোগানে তাঁহাদের বুক কাঁপে— ইহার প্রতিটি কথাই গণতন্ত্রের পক্ষে অতি তাৎপর্যপূর্ণ। ইহা বলিয়া দেয়, শাসকরা যতই দুর্দম হউন না কেন, নাগরিকের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিবার সাধ্য তাঁহাদের নাই। কারণ, সেই প্রশ্নগুলিই আরও অনেক প্রজাকে নাগরিক হইয়া উঠিতে প্রেরণা দেয়। একাধিপত্যকামীরা নাগরিকদের ভয় পান। এই ভয়টিই গণতন্ত্রের জোর।