West Bengal Lockdown

পা বাঁধা পড়েছে পরিস্থিতিতে, হাত বাড়াচ্ছেন যাযাবরেরা

শত শত বছর ধরে তাঁরা হেঁটেছেন। ছড়িয়ে পড়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কেউ থিতু হয়েছেন। কেউ অর্ধেক গতিশীল। করোনা-কালে তাঁরা বাঁধা পড়েছেন। পেট চলা দায়। শত শত বছর ধরে তাঁরা হেঁটেছেন। ছড়িয়ে পড়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কেউ থিতু হয়েছেন। কেউ অর্ধেক গতিশীল। করোনা-কালে তাঁরা বাঁধা পড়েছেন। পেট চলা দায়। লিখলেন রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য

Advertisement

রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২০ ০২:৪২
Share:

গড়বেতায় এক যাযাবর পরিবার। নিজস্ব চিত্র

বিচিত্র জীবন। বৈচিত্রে ভরা ভাষা-জীবিকা। বেদেদের এমন জীবন নিয়ে সংশয়ে পড়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং মুজতবা আলী। ‘বেদে’ নামক রম্যরচনায় রসিকতার ছলে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সংশয়ের কারণ, পৃথিবীর সকল বেদের আদিভূমি নাকি ভারত, এমন দাবি। কিন্তু আলীর মতে, সব দেশের বেদেরা আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ইউরোপের বেদেরা গায়ের রঙে ইংরেজদের কাছাকাছি। শ্রীলঙ্কার বেদেরা ‘ঘনশ্যাম’। আবার আরবের বেদেরা কথায় কথায় ছুরি বার করে। জার্মানির বেদেরা ঘুসি তোলে বটে কিন্তু ফয়সালা করে নেয় বিয়ারের বোতলে। চিনের বেদেরা নাকি চাঁদের দিকে চেয়ে সবুজ চা পান করে। এমন বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের মধ্যে জার্মানির এক বেদে কন্যা সংশয় বাড়িয়ে ছিলেন। তাঁর দাবি, ভারতের সকলেই বেদে।

Advertisement

মজা করে লেখা প্রবন্ধ। কিন্তু মুজতবা আলী বেদে জনজাতির বৈচিত্র একনজরে তুলে ধরেছিলেন। শুধুমাত্র অবিভক্ত মেদিনীপুরে খোঁজ নিলে বেশকিছু যাযাবর সম্প্রদায়ের খোঁজ মেলে। সিয়ালগিরি, কাগমারা, সাপুড়িয়া, বাজিকর বহুরকম বেদে সম্প্রদায়ের সন্ধান মেলে।

‘সিয়ালগিরি’রা বাংলা-ওড়িশা সীমানাবর্তী পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন, মোহনপুর এবং ওড়িশার জলেশ্বর থানার কয়েকটি এলাকাতেই শুধু বাস করেন। রিসলে এঁদের ‘এ ওয়ান্ডেরিং ট্রাইব’ বলেছেন। নৃতত্ত্বের ভাষায় ‘সেমি নোমাডিক’ গোষ্ঠীর সদস্য। ভবিষ্যৎবাণী করে, জাদু দেখিয়ে, বিষাক্ত সাপ ধরে এবং জড়ি-বুটি ওষুধ বিক্রি করে উপার্জন করেন। ‘মিডনাপুর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’ (১৯১১) রচয়িতা ও’ম্যালি এই সম্প্রদায়কে ‘ভবঘুরে ভিল জাতি’র বংশধর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার রয়েছেন কাগমারা সম্প্রদায়। দুই মেদিনীপুরেই তাঁদের দেখা যায়। তাঁরা এসেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। ভাষায় তেলুগু প্রভাব রয়েছে। এই দুই সম্প্রদায়ের অনেকেই থিতু হয়েছেন। মিশে গিয়েছেন বাংলার লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে। রমাপদ চৌধুরীর লেখায় পাওয়া যায় ইরানি যাযাবরদের কথা। যাঁরা প্রতি বছর খড়্গপুরে আসত দল বেঁধে। নলিনী বেরার লেখাতেও এঁদের কথা এসেছে। প্রতি শীতকালে সুবর্ণরেখার পারে নানা যাযাবর গোষ্ঠী আসত। এক বছর এসেছিল ইরানি যাযাবর নাচগানের দল। তাঁদের মেদিনীপুরে থিতু হওয়ার খবর মেলে না।

Advertisement

এখনও মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকায় কিছু যাযাবর গোষ্ঠী ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন। যাঁদের অর্ধেক-থিতু বলা যায়। ছেঁড়া চট, পলিথিন লাঠি, বাঁশের সঙ্গে খাড়া করে কোনও মতে দিনযাপন। কিন্তু নির্দিষ্ট জীবিকাহীন। ঘুরে ফিরে নানা ভাবে পেট চালান তাঁরা। এমন মানুষগুলো এই লকডাউনে পড়েছেন বিপাকে। তাঁদের দিন চলাই ভার হয়ে পড়েছে। খাবারের সন্ধানে কাছেপিঠে যাওয়া। থালা, বাটি, টিফিন বক্সে খাবার নিয়ে ফের চলে আসা ঘাঁটিতে। করোনায় এখন এটাই দস্তুর যাযাবর জীবন।

গড়বেতায় গনগনির প্রান্তরে আস্তানা জিৎ, বিক্রমদের। কথার ফাঁকে এই দুই কিশোর বলে, ‘‘কতদিন যে রেলগাড়িতে চাপিনি!’’ চোখেমুখে তাঁদের আফশোস। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা স্কুলে, খেলার মাঠে যায়। তাদের ট্রেনে চাপার এত শখ কেন? তাদের ঘাঁটিতেই মিলল উত্তর। জিৎ, বিক্রমদের কাজ ছিল গড়বেতা স্টেশনে গিয়ে কোনও না কোনও ট্রেনে উঠে পড়া। তারপর ট্রেনের কামরায় এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ঘোরা, জানলায় উঁকিঝুঁকি মারা, যাত্রীদের কাছে হাত পেতে কিছু চেয়ে নেওয়া। আর স্টেশন এলেই ঝুপ করে নেমে পরের কামরায় চলে যাওয়া। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত তাঁদের ট্রেন সফর বড়জোর বাঁকুড়া বা খড়্গপুর। সন্ধ্যের আগে ফের ট্রেনে চেপেই গড়বেতার ঘাঁটিতে ফেরা। যাযাবর কিশোরদের সেই সফরে ছেদ ফেলেছে লকডাউন। বন্ধ ট্রেন। মন ভাল নেই জিৎ, বিক্রমদের।

মন ভাল নেই চায়না বেদেরও। লকডাউনের সময়েই এই যাযাবর মা হারিয়েছেন তাঁর ছ’বছরের মেয়েকে। মেয়ের নাম ছিল বাবলাবতি। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সে ছিল ছোট। চায়নাদের আস্তানা চন্দ্রকোনা রোড রেলস্টেশন সংলগ্ন জলট্যাঙ্কি পাড়ায়। আশেপাশের যাযাবরদের অন্যতম বড় আস্তানা এটি। কয়েকশো যাযাবর এখানে চট, পলিথিন, ভাঙা টালি, পরিত্যক্ত ত্রিপলের তাঁবু খাটিয়ে দিন গুজরান করেন। লকডাউনে তাঁরা এখন কার্যত তাঁবু বন্দি। এই ঠেকেরই এক জায়গায় ছেঁড়া ফাটা ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া তাঁবুতে চায়নারা থাকেন। স্বামী জিতেনকে নিয়ে দোকানে বাজারে ভিক্ষে করেন তিনি। বড়ছেলে একটা দোকানে কাজ করত। কিছু রোজগারও হত। লকডাউনে দোকান বাজার বন্ধ। পেটে চালানোর উপায় নেই। কাছের একটা লঙ্গরখানায় গিয়ে দুপুরের খাবার পেতেন চায়নারা। সকাল, রাতে এদিক ওদিক করে খাবারের জোগাড় করে চলে যাচ্ছিল কোনও মতে। এরই মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ে বছর ছয়েকের বাবলাবতি। বারবার পেট খারাপ হচ্ছিল। অসুস্থতা বাড়লে স্থানীয় দ্বারিগেড়িয়া গ্রামীণ হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে যান মা, দাদা। ততক্ষণে বাবলাবাতিকে বাঁচানো যায়নি। চায়না বলেন, ‘‘সেইসময় গাড়ি চলছিল না, মোটর বাইকেও যাওয়া যাচ্ছিল না রাস্তায় কড়াকড়ি হওয়ায়।
অসুস্থ ছোট মেয়েকে সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। শেষ মুহূর্তে নিয়ে গেলেও বাঁচাতে পারিনি মেয়েকে।’’

চন্দ্রকোনা রোডেই থাকেন চণ্ডুল বেদে। মধ্য ত্রিশের সুঠাম চেহারার চণ্ডুল এই তল্লাটের যাযাবরদের মুখিয়া। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু চন্দ্রকোনা রোড বা গড়বেতার নয়, লকডাউন হয়ে যাওয়ায় সব যাযাবর সম্প্রদায়ই এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। বেঁচেবর্তে থাকায় দায়!’’ গড়বেতা ১ বিডিও অফিসের পিছনের ডাঙাপাড়ার যাযাবর পল্লি থেকে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে দেব। পড়ত গড়বেতারই একটা স্কুলে। এই প্রথম এখানকার যাযাবরপল্লি থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে একজন। এখনও ফলপ্রকাশ হয়নি। দেব বলে, ‘‘যাযাবর মানে ভবঘুরে, ঘোরাঘুরি, আমরা বেঁচে থাকার রসদ পাই এভাবেই। লকডাউনের ফলে সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের চিন্তার শেষ নেই।’’ যাযাবরদের অনেকেই ভাঙা বাংলায় কথা বলতে পারেন।

নির্দিষ্ট কোনও জীবিকা কোনওদিনই ছিল না যাযাবরদের। নানা কাজ করে তাঁরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাড়ি দিতেন। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত তাঁদের বাচ্চারা চন্দ্রকোনা রোডে দড়ির উপরে খেলা দেখাত। কিন্তু অর্ধ থিতু জীবনে সবই বন্ধ। পাশে দাঁড়িয়েছেন কয়েকজন। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোও। চন্দ্রকোনা রোডের দুই ব্যবসায়ী ভাই পলাশ ও পিয়াল তিওয়ারি লকডাউনের সময় দিন পনেরো এলাকার যাযাবর, ভবঘুরেদের রান্না করে খাবার বিলি করেছেন। কিন্তু এখন সেসব বন্ধ। কয়েকটি ক্লাব, সংস্থা, সংগঠন থেকেও যাযাবরদের রান্না করা খাবার বিলি করা হয়েছে। গড়বেতায় একসময় যাযাবরদের জীবনযাত্রার মান বদলাতে চেষ্টা করেছিলেন শিক্ষক তপন ঘোষ। এবার লকডাউনে তাঁদের হাতে খাদ্যসামগ্রীও তুলে দেন তিনি। এই শিক্ষককে এখনও ‘স্যার’ বলে মানেন গড়বেতার বহু যাযাবর। গড়বেতা ১ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি সেবাব্রত ঘোষ, গড়বেতা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান শ্যামল বাজপেয়ীরা লকডাউনে বন্দি যাযাবরদের নানাদিক দিয়ে সাহায্য করেছেন। কিন্তু এখন অনেক ‘কমিউনিটি কিচেন’ই বন্ধ।

আতান্তরে পড়েছেন যাযাবরেরা। ইতিহাস বলে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলে জায়গা বদলে নিয়েছিলেন যাযাবরেরা। এখন সেই উপায়ও নেই। পথ যে রুদ্ধ। ফলে পেটের তাগিদে যাযাবরদের হাত বাড়াতে হচ্ছে।

কৃতজ্ঞতা: নলিনী বেরা, সন্তু জানা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement