পাড়াটা দেখলে ভয় করে
সন্ধ্যেটা কিছুতেই কাটতে চাইছে না পিয়ালির। দিনের বেলা যেমন তেমন। রাত হলেই ইদানীং কেমন যেন ভয় ভয় করে। মাঝে মাঝে কুকুরগুলো অদ্ভুত সুরে ডেকে ওঠে।
চেনা মহল্লাটা কবরস্থান বলে মনে হয় যেন। হবে না-ই বা কেন? গত দু’সপ্তাহে বিলকুল বদলে গিয়েছে নবদ্বীপের দশ নম্বর ওয়ার্ডের তেলিপাড়ার লেন। অথচ সন্ধ্যা যত রাতের দিকে গড়াত ততই জমজমাট হয়ে উঠত ঘিঞ্জি গলিটা। বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যায় ভদ্দরলোকের আনাগোনা। সেই সঙ্গে হইহল্লা, চিৎকার। মাসির সঙ্গে মদ্যপ লোকের অশ্রাব্য ঝগড়ায় সরগরম রাত।
শুধু শব্দ নয়। গলিটার একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। শব্দের সঙ্গে সেটাও মিশে থাকত। পেঁয়াজ-রসুনে কষানো মাংস, ঘুগনি, ছোলা সেদ্ধ, পাউরুটি সেঁকা, তেলেভাজার সঙ্গে পোড়া বিড়ি, সিগারেট ও মদের গন্ধের মিশেল। এমন পরিবেশে বিকেল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত কাজ করতেন পিয়ালি। তার পর স্নানটান সেরে রাতের খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে বিছানায় যেতে যেতে মাঝ রাত। এর মধ্যে কোনও উটকো ঝামেলা হলে তো কথাই নেই। এমনও হয়েছে কোনও কোনও দিন শুতে শুতে তিনটেও বেজে গিয়েছে।
পিয়ালির কথায়, “কী ভাবে যে সময়টা রোজ কেটে যেত বুঝতে পারতাম না। এক এক দিন যখন শরীর চলত না, তখন নিজের মনেই ভাবতাম এমন একটা কিছু হোক, যাতে বেশ ক’দিন সব বন্ধ থাকে। তখন তো জানতাম না করোনা এসে এ ভাবে সত্যিই সব বন্ধ করে দেবে। পাড়াটা দেখলে এখন খুব ভয় করে! গাঁয়ের কবরস্থানের কথা মনে পড়ে। মনে হয় যতই ঝামেলা অশান্তি থাকুক, আগেই ভাল ছিলাম। রোজগার ছিল। খেতে পেতাম। টাকার চিন্তা ছিল, কিন্তু রোজের ভাতের জন্য এ ভাবে ভাবতে হত না। তাড়াতাড়ি সব যেন আগের মতো হয়ে যায়।”
পিয়ালির মতো জনা পঞ্চাশেক যৌনকর্মীর বাস নবদ্বীপের তেলিপাড়ার একটি পল্লিতে। ওঁরা যৌনকর্মী, লকডাউনে রোজকার খাবার জোগাড়ে যাঁদের কালঘাম ছুটছে। সবাই মনেপ্রাণে চাইছেন— সব কিছু আগের মতো হয়ে যাক।
খারাপ থাকার পরিমাণটা অন্তত একটু কমবে। পেটে ভাত পড়বে।
সারা সকালটি বসে বসে
আগে নন্দার দিন শুরু হতেই ন’টা বেজে যেত। তত ক্ষণে আশপাশের অনেকের কাচাকাচি, স্নান, পুজো সারা হয়ে গিয়েছে।
আসলে অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইল ঘাঁটা নন্দার ভীষণ নেশা। অত রাতে ঘুমোলে বেলায় ওঠা ছাড়া উপায় কী! উঠেই অবশ্য ভীষণ তাড়াহুড়ো লেগে যেত। স্নান করেই বাজারে ছুটতে হত। ফিরে এসে জলখাবার তৈরি করে খেয়ে হিসাবে বসতে হতো।
ঘর ভাড়া, আগের রাতের বিভিন্ন দোকানে বকেয়া হিসাব মিটিয়ে দিয়ে তার পর দিনের কাজ। দুপুরের রান্না বসাতে একটা-দেড়টা বেজে যেত ওঁর। তার পর ফের একটু বিশ্রাম করে বিকেলের প্রস্তুতি।
এখন অবশ্য আরও দেরি করে বিছানা ছাড়েন নন্দা। বলেন, “কী করব। কোনও কাজ নেই। সারা সকাল শুধু বসে বসে গুলতানি করা। ভাল লাগে না। হাতে পয়সা নেই। একটু দেরিতে উঠলে জলখাবারের ঝামেলা থাকে না। স্নান করে চা খাই। তার পর একেবারে দুপুরের খাওয়া। সকাল বিকেল-টিফিনের খরচ বেঁচে যাচ্ছে। মানে বেশ ক’টা টাকা। এই বাজারে সেটাই বা কম কী? ওই টাকাটা বাড়িতে পাঠাতে পারলে কাজ হত।”
নদিয়ার পার্শ্ববর্তী জেলায় বাড়ি নন্দার। বাড়ির লোকেরা জানেন, তিনি আয়ার কাজ করেন। প্রতি মাসের প্রথম দিকে দু’এক দিনের জন্য বাড়ি যান। গিয়ে সংসার খরচের টাকা দিয়ে আসেন। বাবা অসুস্থ। ভাই বিয়ে করে আলাদা। মা বিড়ি বেঁধে সামান্য কিছু আয় করলেও সংসারের প্রধান খরচ দেন নন্দাই।
তিনি যৌনকর্মী।
এ মাসে কোনও রোজগার নেই। তাই এ মাসে বাড়ি যাওয়ার প্রশ্নও নেই। এমনিতেও লকডাউন চলছে। জানেন, মায়ের হাতে টাকা নেই। বাবার ওষুধ কেনা হবে কী করে, মাথার মধ্যে চিন্তার বুদবুদ কাটে সার দিন।
সারা সকাল বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই কথা ভাবতে ভাবতে জলখাবারের খরচ বেঁচে যায় নন্দার। খিদে মরে যায় যে।
হাঁটি হাঁটি পা পা
সুনসান গলির রাস্তায় কেউ ঢুকলেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তাঁর কাছে চলে যাচ্ছে বছর ছয়েকের ফুটফুটে মেয়েটা।
রঙিন ফুলকাটা স্লিভলেস ফ্রক। কী রে অমন করে হাঁটছিস কেন?— জিগ্যেস করলেই সাবধানে বাঁ পায়ের ফ্রকটা সরিয়ে দেখাচ্ছে থাইয়ের কাছের ক্ষতটা দেখাচ্ছে। দগদগে ঘা।
কী করে হল? মেয়েটির মা সুলতা বলেন, “শুকনো বিপদ আর কাকে বলে! সসপ্যানে চা ভিজতে দিয়ে ঘরের বাইরে গিয়েছিলাম। সেই ফাঁকে চা ছাঁকতে গিয়ে গরম চা সব পায়ের উপর পড়েছে মেয়ের। এমনিতেই হাতে টাকা-পয়সা নেই, এর মধ্যে ওষুধপত্রের বাড়তি খরচ।”
বেশ হিসাব করে গুছিয়ে কথা বলেন সুলতা। জানান, জনতা কার্ফুর আগের দিন ছিল শনিবার। সেই রাতে শেষ কিছু রোজগার হয়েছিল। রবিবার জনতা কার্ফু। সোমবার বিকেল থেকে লকডাউন। সেই থেকেই উপার্জনহীন দিন কাটছে। তাঁর অর্থনৈতিক পদক্ষেপও এখন তাঁর মেয়ের মতোই টালমাটাল।
তেলিপাড়া লেনের বাসিন্দাদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যাঁদের কাছাকাছি বাড়ি, তাঁরা অনেকে লকডাউন শুরুর দিন সকালেই এখান থেকে চলে গিয়েছেন। সুলতার মতো অনেকের যাওয়ার জায়গা নেই। মেয়ে বা ছেলে নিয়ে এখানেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে।
সুলতা বলেন, “হাতে কম-বেশি সকলেরই কিছু টাকাপয়সা এখনও আছে আমাদের। পুরসভা বা বিভিন্ন সংস্থা কিছু কিছু সাহায্যও করছে। কিন্তু যাঁদের বয়সের কারণে উপার্জন কম, যাঁরা অসুস্থ— তাঁদের কী হবে বলতে পারেন? লকডাউন কবে উঠবে, তা-ও তো বুঝতে পারছি না। আর উঠলেও করোনা নিয়ে যা শুনছি, তাতে আমাদের কাজ করা কতটা নিরপদ হবে?’’
সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোয় যৌনকর্মীদের পেটের ভাত জোগাড়ের ব্যবস্থা কী যে হবে, কিছুই বুঝতে পারছেন না ওঁরা।
(নিরাপত্তার কারণে সকলের নাম পরিবর্তিত। সঙ্গের ছবি প্রতীকী)