কংক্রিটের জঙ্গলে
কবি বলেছিলেন, ‘যে জন আছে মাঝখানে’। কিন্তু এ ব্যাটারা উপরে-নীচে-মাঝখানে ওঠানামা করতে করতে করতে, কখনও হাওয়ায় দোল খেতে খেতে, কখনও আবার দিব্যি স্থির হয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর। বাদুড় না হয়েও যে সারাটা জীবন ঝুলেই কাটিয়ে দেওয়া যায়, ফ্ল্যাটের জঙ্গল গজিয়ে না উঠলে কি কেউ টের পেতেন! যাঁরা বলেন, থলে থলে বই আর কিছু না, তাঁরা ঠিক বলেন না। কারণ, থলের পেটে শুধু পণ্যই নয়, থাকে অসংখ্য ঘটনার সাক্ষ্যও। সেই কারণেই তারা সাক্ষী। অথচ, পুলিশ তাদের বয়ান নেয় না, আদালতও তলব করে না। শুধু কোনও কোনও কোনও রাতে বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় ওদের ফিসফিস।
আলুথালু সুখ
যে বয়, সে রয়। যে না বয়, সে ব্যাড বয়। চকিতে, এই হল থলের জীবন-দর্শন। ফলে, খোলা হোক বা বাঁধা, বইতে তাকে হবেই।
স্কোয়ার ফুট, লোন, ইএমআই-এর চুলচেরা হিসেব করে একদিন ফ্ল্যাট-প্রবেশ হল। দরকারি এবং আদরকারি নানা জিনিসপত্রে ভরে উঠল ঘর। তড়িঘড়ি বাড়ির কর্তা পাড়ার দোকান থেকে কিনে আনলেন একটি পোক্ত থলে আর বেশ লম্বা নাইলনের দড়ি।
বাড়ির কর্ত্রী তো হুকুম করেই খালাস! কর্তা ব্যলকনিতে সেই থলে আর দড়ি নিয়ে বসলেন। ‘বাবা, বুঝি ম্যাজিক করছ?’ বলে বাপের পাশে বসে পড়ল খুদে মেয়েটিও। বড় বড় চোখ করে সে দেখল, ব্যাগের হাতলে দড়ি বাঁধা হল। এ বার ব্যালকনির গ্রিলের সঙ্গে দড়ির আর এক প্রান্ত বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হল থলে।
হাওয়ায় যেই দুলে উঠল ব্যাগ, ছোট্ট মেয়েটি খিলখিলিয়ে উঠল— ‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমাদের ব্যাগ উড়ছে!’ থলেটিও যেন বলে উঠল, ‘ডানা বেঁধে দিলে কি আর ওড়া যায় রে মা!’ তা ছোট্ট মেয়েটিকে ভাল লেগে গেল থলের।
সকালে খবরের কাগজ, দুধের প্যাকেট। বাড়িতে কেউ এলে চাবির থোকা। কোনও কোনও দিন টুকিটাকি জিনিসপত্র। ব্যস! বাকিটা সময় স্রেফ ঝুলে ঝুলেই পড়শি থলেদের সঙ্গে আড্ডা। কখনও কখনও খুদে মেয়েটি খেলনাবাটি নিয়ে এসে বসে ব্যালকনিতে। তার পরে কচি হাতে দড়ি ধরে মারে টান। ‘কাজ আছে’ ভেবে উঠে আসে থলে। তার পরে পুতুলদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় মেয়ে, ‘এর নাম ব্লু ব্যাগ। ও উড়তে পারে। তোরা দেখবি? ব্লু-ব্যাগ, তুমি এ বার উড়ে দেখাও।’ ফের দড়ি ঢিল দেয় মেয়ে।
থলের রোজনামচায় কাজ কম। উড়তে হয় বেশি। শহুরে থলে নিজেকে বেশ স্মার্ট ভাবে। গাদা, গাদা আনাজ নিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলে থাকতে হয় না। বিরক্তিকর ভাবে পায়ের ধাক্কা খেতে হয় না। পশ্চাতের নীচে রেখে কেউ তার উপরে থেবড়ে বসেও না। সে স্মার্ট, তার লাইফস্টাইল আরও স্মার্ট!
মেরুন পিএনপিসি
পাশের ফ্ল্যাট: ‘তোর তো ভাই ব্যাপারই আলাদা। পলকা চাট্টি জিনিস উপরে তুলছিস। আর খুকির সঙ্গে খেলছিস!’
ব্লু ব্যাগ: ‘অমন করে বলছিস কেন! তুই-ই তো খারাপ নেই। তোর দোতলা। টুক করে উঠে পড়িস। আমাকে তো চার তলা উঠতে হয়।’
ছ’তলা: ‘এ সব কাকে শোনাচ্ছিস! চার-ছয় এ সব ক্রিকেটে ভাল লাগে রে। কিন্তু আমাদের তো জান কয়লা হয়ে যায়।’
তিন তলা: ‘বাদ দে তো! রোজ সেই এক আলোচনা, কাকে কোথায় উঠতে হয়! বলছি, এই ছ’তলা, তোর মালিক কি প্রেম-ট্রেম করছে নাকি রে? বেশ কয়েকদিন অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে উপরে উঠতে দেখলাম।’
পাশের ফ্ল্যাট: ‘আমার চোখেও পড়েছে। তার মানে আবার একটা অঘটন ঘটবে।’
ব্লু ব্যাগ: ‘তোর মনে কি সব সময় কু ডাকে নাকি রে! সেই তিন তলায় একটা মার্ডার হল বলে সবার ক্ষেত্রেই তাই হবে না কি!’
তিন তলা: তা হয়তো হবে না। কিন্তু সময়টাও ভারী গোলমেলে। যাক গে, অনেক রাত হল! এ বার ঘুমোতে চল।
স্পষ্ট মনকেমন
ব্লু-ব্যাগের ক’দিন ধরে মন ভাল নেই। খুদে মেয়েটি আর তাকে টেনে তুলে পুতুলদের আসরে নিয়ে যায় না। কোন এক সিরিয়ালে তার মা নাকি দেখেছে, থলের দড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে একটি বাচ্চা গলায় দড়ি দিয়ে ফেলেছিল। শেষে সেই সিরিয়াল-বাড়ির কাজের মেয়ে দেখতে পেয়ে বাচ্চাটিকে বাঁচায়। তার পর থেকে ব্লু-ব্যাগের মালকিন মেয়েকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘ওই ব্যাগ আর দড়ি নিয়ে তোমাকে যেন আর কখনও খেলতে না দেখি!’ তার পর থেকে ব্লু-ব্যাগ সুযোগ পেলেই তেড়ে গাল দেয় বাংলা সিরিয়ালগুলোকে।
কয়েকদিন ধরে থলেদের আড্ডাটাও আর জমছে না। পুরনো দু’টি থলে তাদের দলে আর নেই। ছ’তলার ফ্ল্যাট ক’দিন ধরেই বন্ধ। সেই থলেও আর নীচে নামে না। পাশের ফ্ল্যাটের থলের জায়গা নিয়েছে নতুন একটি থলে। তার সঙ্গে সবার এখনও আলাপ জমেনি। প্রথম প্রথম অবশ্য এমনটাই হয়। তার পরে ধীরে ধীরে সবাই বন্ধু হয়ে যায়। মাঝে মাঝে শুধু পুরনো থলেগুলোর মুখ মনে পড়ে যায় কারও কারও। মনে পড়ে পুরনো কত কত কথা। নিঃশব্দে কি চোখের জল ফেলে ওরাও?
টলতে টলতে
বস্তির পাশের পাড়াতেও এখন অজস্র ফ্ল্যাট মাথা তুলেছে। বস্তির বাড়িতে ফেরার সময় ফ্ল্যাটগুলোর দিকে তাকিয়ে টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দিবাকর দত্ত তিনটে দেশলাইয়ের কাঠি খরচ করে ফেললেন। কিন্তু বিড়ি ধরল না। বাতাসকে তেড়ে একটা গাল দিয়ে তিনি একটা ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়ালেন। বিড়ি ধরালেন। একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটা ছাড়তেই তাঁর মনে হল, আলতো করে তাঁর হাত ছুঁয়ে কী একটা চলে গেল। চমকে তাকাতেই তিনি দেখলেন, দড়িবাঁধা একটা নীলচে ব্যাগ ক্রমশ উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। অনেকক্ষণ ধরে তিনি উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিন্তু ব্যাগের গন্তব্য ঠাওর করতে পারলেন না।
দিবাকর যে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তা তাঁর সঙ্গী মানব মজুমদার বেশ কিছুক্ষণ খেয়াল করেনি। তিনিও টলটে টলতে আগডুম বাগডুম বকতে বকতে যাচ্ছিলেন। কোনও সাড়া না পেয়ে তিনি পিছনে তাকিয়ে দেখেন, দিবাকর নেই। ফের পিছনে এগিয়ে এসে মানব দেখতে পান, দিবাকর উপরের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলছেন।
মানব তেড়ে একটা খিস্তি করে বলেন, ‘এখানে আবার কাকে ডায়ালগ ঝাড়ছ গুরু! তুমি দেখছি, ফুল পেগলে গিয়েছ। এখন হাওয়ার সঙ্গেও কথা বলছ!’ দিবাকরের সম্বিৎ ফেরে। হাতের বিড়ি অভিমানে নিভে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। ফের সেটাকে ধরিয়ে দিবাকর হাঁটা দেন। হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘আজব জীবন!’
দিবাকর যে আটপৌরে থলের জীবন নিয়ে ভাবিত, তা অবশ্য মানব বুঝতে পারলেন না। তবে তিনি কাছাকাছি ভেবেছেন। মানব বললেন, ‘শোনো গুরু, ফ্ল্যাটের এই ব্যাগগুলো কিন্তু বেশ কাজের। আমি তো এ ভাবেই এক রাতে মদ খেতে খেতে ফিরছিলাম। বোতল শেষ হয়ে গেল। খালি বোতল ফেলব কোথায়? তখন দেখি, হতচ্ছাড়া বড়লোকদের ফ্ল্যাট থেকে অনেক ব্যাগ ঝুলছে। দিলাম বোতলটা ওর একটার মধ্যে ঢুকিয়ে। পরের দিন সকালে ব্যাগ যখন উপরে পৌঁছল কী কাণ্ডটা হয়েছিল ভেবে আমার তো এখনও হাসি পায়।’ দিবাকর শুধু গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন, ‘কাজটা কিন্তু তুই ভাল করিসনি, মানব।’
মানব নেশার ঘোরে মনে করতে পারেন না সেদিন তিনি ঠিক কোন ফ্ল্যাটের, কোন ব্যাগে ফাঁকা মদের বোতল রেখেছিলেন। কিন্তু নীল ব্যাগকে সারারাত ওই বোতল পেটে নিয়ে ঝুলে থাকতে হয়েছিল। অসম্ভব বিরক্তি নিয়েও সেদিনই প্রথম অ্যালকোহলের তীব্র অথচ মাদকতা মেশানো গন্ধটা টের পেয়েছিল নীল ব্যাগ।
লকডাউন ঝটকা
থলেদের তো দিবারাত্রি আপ-ডাউন করতে হয়। বন্ধুদের আড্ডায় নীলডাউনও কথাটাও ভাসে মাঝেমধ্যে। কিন্তু লকডাউন কী? টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর ‘জাতির উদ্দেশে ভাষণ’ শোনার পরে বেশ একচোট আলোচনা চলেছে থলেদের মধ্যে। কেউ বলেছে, ‘যাক, এ বার তবে ক’দিন ছু’টি।’ কেউ আবার ধমকে বলেছে, ‘যত বয়স বাড়ছে তত তোর জ্ঞান-বুদ্ধি কমছে। ছুটি ভুলে যা।
এখন কাজের চোটে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হবে।’
তা কথাটা ঠিক। তামাম দুনিয়া ছুটিতে চলে গিয়েছে। আর গুচ্ছ গুচ্ছ ভর ও ভার সামলাতে হচ্ছে ফ্ল্যাটের থলেগুলোকে। সকালের দুধ, খবরের কাগজ থেকে আনাজ, মাছ এ সব তো আছেই। তার সঙ্গে রাতের দিকে যোগ হয়েছে কর্তার সিগারেটের প্যাকেট আর ব্ল্যাকে আসা হুইস্কির বোতলও। নিট ফল, দিবারাত্রি টাকা পেটে করে নামো রে, আর গাদা গাদা জিনিসপত্র নিয়ে ওঠো রে।
আগে সারা সপ্তাহে এক বার স্নান করলেই চলত। এখন প্রতিবার উপরে ওঠার পরেই ফ্ল্যাটের মালিক বা মালকিন থলের উপরেও ছিটিয়ে দিচ্ছেন বিটকেল গন্ধওয়ালা স্যানিটাইজ়ার। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে থলের দল বলে ওঠে, ‘এটা কি জীবন হল, কালীদা? এর চেয়ে তো লকআউটও বোধহয় ঢের ভাল ছিল!’’
এবং ভোকাট্টা
অবশেষে অপেক্ষার অবসান। টিভিতে ফের দেশের উদ্দেশে, দশের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন রাষ্ট্র ও রাজ্যের প্রধানেরা। দীর্ঘ লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে এবং নাগাড়ে সাবান ও স্যানিটাইজ়ার ঘষে ঘষে আমরা বেআক্কেলে ভাইরাসকে তাড়াতে পেরেছি। লক্ষ লক্ষ মৃতদের আত্মার শান্তি কামনা করে নতুন সভ্যতা সমস্বরে গান ধরেছে— ‘আহা কী আনন্দ আকাশে, বাতাসে...।’
দীর্ঘ লকডাউনে ব্ল্যাকে বেশি টাকা গুনে মদ কিনতে পারেননি দিবাকর। পৃথিবী যেমন কিছুটা দূষণমুক্ত হয়েছে, তেমনি লকডাউনের সৌজন্যে দিবাকরও মদের নেশা ছেড়ে দিতে পেরেছেন। বহু দিন পরে রিকশা নিয়ে বেরোলেন দিবাকর। রোজগারও খারাপ হল না। থলেভর্তি বাজার করে ঘরে ফিরলেন দিবাকর।
সে রাতে দিবাকর স্বপ্নে দেখলেন, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি নয়, গোটা আকাশ জুড়ে উড়ছে রংবেরঙের থলে। মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ির সুতোর মতো থলের দড়িগুলোও হাওয়ায় ভাসছে। ছাদের উপরে উঠে সকলেই হইহই করছে। মাঝেমধ্যেই ভেসে আসছে— ভোকাট্টা! কিন্তু কারও হাতে কোনও লাটাই নেই। আর ওই দূরে একটা নীলচে ব্যাগ যেন ঝাঁক থেকে আলাদা। হাওয়ায় ভাসছে। স্থির। এবং বিষণ্ণ।