পাশাপাশি

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মেরুকরণের ষড়যন্ত্র হইতে পশ্চিমবঙ্গও মুক্ত নহে। একাদশীতে বিসর্জনের দাবিতে শোরগোল তুলিবার পিছনেও তাহার বড় ভূমিকা থাকিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

দুর্গাপূজা শুরু হইবার আগে বিসর্জন লইয়া এত আলোচনা, এই শোরগোলপ্রিয় পশ্চিমবঙ্গেও, অভূতপূর্ব। বিতণ্ডা হাই কোর্ট অবধি গড়াইয়াছে। উচ্চ আদালত কেন এই সমস্যা বিচারের জন্য গ্রহণ করিলেন— সেই প্রশ্ন তুলিলে ভুল হইবে, কারণ প্রশ্নটি ছিল অধিকার সংক্রান্ত। বিসর্জনের অধিকার। মহরমের দিনটিতে কেন পূজার আয়োজকদের সেই অধিকার থাকিবে না, এই প্রশ্নেই মামলা হইয়াছিল। অধিকার ও তাহার সীমা নির্ধারণের দায়িত্ব এবং এক্তিয়ার নিশ্চয়ই বিচারবিভাগের। মামলার বিচার করিতে গিয়া মহামান্য বিচারপতিরা অবশ্য বিসর্জন বলিতে ঠিক কী বুঝায়, সেই কূটপ্রশ্ন তোলেন নাই। শোভাযাত্রা সহকারে প্রতিমা বিসর্জন একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, দেবীর শাস্ত্রীয় বিসর্জন তথা নিরঞ্জন হইতে যাহা স্বতন্ত্র। দেবীর নিরঞ্জন শাস্ত্রমতে বিজয়া দশমীতেই সম্পাদন করিতে হয়। সুতরাং মহরম তথা একাদশীর দিন শাস্ত্রীয় নিরঞ্জনের প্রশ্ন নাই, প্রশ্ন বিসর্জনী শোভাযাত্রার। শোভাযাত্রার অধিকারও নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। আদালত সেই অধিকারকে মর্যাদা দিয়াছেন। রাজ্য সরকার সেই দিন প্রতিমা বিসর্জন নিষেধ করিয়া যে নির্দেশ দিয়াছিল, তাহা নাকচ করিয়াছেন। রাজ্য সরকার আদালতের রায় মানিয়া লইয়াছে, আপিলে যায় নাই। দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটিয়াছে।

Advertisement

দ্বন্দ্ব কথাটি এ কালে বিরোধের সমার্থক বলিয়া গণ্য। এই শব্দের আদি অর্থ কিন্তু বিরোধ নহে, যুগল। সেই যুগলের সম্পর্ক বিরোধের হইতে পারে, সমন্বয়েরও হইতে পারে। ব্যাকরণে রামরাবণও দ্বন্দ্বসমাসনিষ্পন্ন, রামলক্ষ্মণও। দ্বন্দ্বকে এই বৃহত্তর অর্থে গ্রহণ করিলে নূতন সম্ভাবনা সৃষ্ট হয়। উচ্চ আদালত প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, দুইটি ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বাস করেন, তাঁহাদের অনুষ্ঠানগুলি কেন একই সঙ্গে করা যাইবে না? প্রশ্নটি সহাবস্থানের। সম্প্রীতিরও। বঙ্গীয় তথা ভারতীয় সমাজে স্বাভাবিক সম্প্রীতির ধারাটি আজও প্রবল। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের উৎসবে যোগ দেন, তাহাকে সার্থক করিয়া তুলিতে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া কাজ করেন। ফি বৎসর শারদোৎসবেই তাহার বহু নিদর্শন। এই সম্প্রীতির শিকড়টি গভীরচারী বলিয়াই এত কাল ধরিয়া পাশাপাশি বসবাস, পাশাপাশি উৎসব, পাশাপাশি ধর্মাচরণ চলিয়া আসিতেছে। স্বাভাবিক শুভবুদ্ধি এবং কাণ্ডজ্ঞানের প্রেরণাতেই মানুষ পরস্পরকে কিছুটা জায়গা ছাড়িয়া দিয়াছে, পরস্পরের স্বার্থে আপন স্বার্থকে কিছুটা সংযত করিয়াছে। এই আত্মনিয়ন্ত্রণ দ্বিপাক্ষিক বলিয়াই পারস্পরিক বিবাদের উৎস হয় নাই, পারস্পরিক শক্তির উৎস হইয়াছে। সহজ সুগভীর প্রত্যয়ে জানাইয়া দিয়াছে— রামরহিমের দ্বন্দ্বসমাস বিরোধের নহে, ঐক্যের।

সমস্যা হয়, যখন এই স্বাভাবিক সহাবস্থানের পরিসরে দুর্বুদ্ধির অনুপ্রবেশ ঘটে। বিরোধ সৃষ্টির দুর্বুদ্ধি। সেই নির্মিত বিরোধকে কাজে লাগাইয়া রাজনীতির বিষবৃক্ষে ফল পাকাইবার দুর্বুদ্ধি। এই অশুভ রাজনীতির লীলা সাম্প্রতিক ভারতে অতি প্রকট। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মেরুকরণের ষড়যন্ত্র হইতে পশ্চিমবঙ্গও মুক্ত নহে। একাদশীতে বিসর্জনের দাবিতে শোরগোল তুলিবার পিছনেও তাহার বড় ভূমিকা থাকিতে পারে। এই প্রেক্ষিতে হাই কোর্টের রায়টি বিশেষ মূল্যবান। আদালত রাজ্য প্রশাসনকে পরিস্থিতি সুনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়াছেন। আশা, প্রশাসন দায়িত্ব পালনে একশো শতাংশ তৎপর হইবে। আশা, রাজ্যের শাসকরা প্রশাসনকে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিবেন, অধিকারও দিবেন, দলীয় স্বার্থ কোনও ভাবেই রাজধর্ম পালনের অন্তরায় হইবে না। মহরমের দিন নিরঞ্জনের ‘সমস্যা’কে সুযোগ হিসাবে দেখিবার কারণ আছে। মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রতিহত করিয়া সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে, অক্ষুণ্ণ রাখিবার, বস্তুত আরও জোরদার করিবার সুযোগ। আমাদের বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গ সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিবে। সম্প্রীতি জয়ী হইবে। প্রমাণিত হইবে— দ্বন্দ্ব বলিতে কেবল বিরোধ বুঝায় না, যুগলও বুঝায়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement