ছবি: সংগৃহীত
স্কুল ব্যাগের ভার বইতে বইতে ছাত্র-ছাত্রীরা সত্যিই ক্লান্ত। দিনের পর দিন ছোট ছোট বাচ্চাদের পিঠে এই স্কুল ব্যাগের ভার ক্রমশই যেন বেড়ে চলেছে। সুখের খবর, স্কুল ব্যাগের ভার কমাতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। এই উদ্যোগকে প্রথমেই স্বাগত জানাই। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা কি সারা রাজ্যের সমস্ত সরকারি, সরকার পোষিত এবং বেসরকারি বিদ্যালয়ে সফল হবে? সারা রাজ্যে প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিদ্যালয়ে সংখ্যা নেহাত কম নয়। সরকারের পক্ষে, এই বিশাল সংখ্যক বিদ্যালয়ে লকারের ব্যবস্থা করা কি আদৌ সম্ভব, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তারপরে এমন প্রচুর বিদ্যালয় আছে যেখানে স্থান অপ্রতুল। অনেক বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা তিন হাজারের উপরে। লকার সিস্টেম বই খাতার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়তো সম্ভব হল, কিন্তু সেখানে কোন বই ও খাতা ছাত্র বা ছাত্রী রাখবে আর কোন বই খাতা নিয়ে বাড়ি যাবে, তাতেও প্রাক প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে। তাতে আবার পড়াশোনায় আরেক অসুবিধার সম্মুখীন হবে তারা। রাজ্যের প্রতিটি ছাত্র ও ছাত্রীর স্কুল ব্যাগের ভার লাঘব করার জন্য সরকারের এই লকারের ভাবনা কতটা ফলপ্রসূ হবে তাতে সন্দেহ থেকে যায়।
এই ভাবনা থেকে সরে বরং অন্য ভাবেও তাদের ভার লাঘব করা যায় কি না, সেই সমস্ত বাস্তব এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধানসূত্রের খোঁজ নিলে ক্ষতি কী? এটা ঠিক একটি নামী সংস্থা ভারতের চারটি বড় শহরে ২ হাজার ৫০০ জন ছাত্রছাত্রীর উপর সমীক্ষা করে দেখেন, ছাত্রছাত্রীরা যে ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে যেই ব্যাগের ওজন সেই ছাত্র ছাত্রীর ওজনের প্রায় ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ; যা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক এবং ডাক্তারি শাস্ত্রের পরিপন্থী। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে একজন ছাত্রছাত্রীর ব্যাগের সর্ব্বোচ্চ ওজন হতে পারে তার ওজনের ১০ শতাংশ।
ব্যাগের ওজন তার থেকে বেশি হলে সেই ছাত্রছাত্রী বহন করতে পারবে ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ দিন বহন করতে করতে তার হাতে, কাঁধে, মেরুদণ্ডে এমনকি মাথায়ও ব্যথা অনুভব করবে এবং আস্তে আস্তে অনেক ক্ষেত্রে ছোটো বয়স থেকেই মেরুদণ্ডের রোগে আক্রান্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারবে না। অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে এই ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রচুর শিশুকে চিকিৎসার জন্য অভিভাবকদের নিয়ে যেতে হচ্ছে।
আমাদের অজ্ঞতার জন্য আগামী দিনের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের পরিবর্তে এক অসুস্থ, শারীরিক সক্ষমতাহীন, দুর্বল যন্ত্রণাময় জীবনে ঠেলে দিচ্ছি। দীর্ঘকাল শিক্ষকতার ব্রতে আসীন থেকে লক্ষ্য করছি বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন রোগে ভোগে, যা তাদের স্বাভাবিক ছন্দে বেড়ে ওঠার একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। তার উপর শিক্ষাব্যবস্থার দূরদর্শিতার অভাবে ছাত্রছাত্রীদের উপর এরকম ৮ থেকে ১০ কেজি ওজনের ব্যাগ চাপিয়ে আরও গভীরতর সমস্যার সম্মুখীন হতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এই ব্যাগের ভার কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ করে বেসরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপরে এই ভার কমানোর জন্য সরকারের কিছু কিছু বিষয়ে একটু অতিরিক্ত নজর দেওয়া প্রয়োজন। আগামী প্রজন্মকে একটু স্বস্তি দিয়ে, সুস্থ, স্বাভাবিক ভাবে পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। সরকারের উচিত বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির উপরে নজরদারি বাড়ানো। অর্থাৎ, বিভিন্ন শ্রেণিতে ঠিক কী কী বই কিনতে হবে, কী কী উপকরণ সর্বদা সঙ্গে রাখতে হবে, সে সব বিষয়ে সরকারের নজর থাকা দরকার। প্রতিদিনের টাইমটেবিল ও বিভিন্ন ধরনের সিলেবাস ভিত্তিক প্রজেক্ট ওয়ার্ক বিদ্যালয়েই করিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করলে দু’ভাবে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকেরা উপকৃত হবে। প্রথমত প্রজেক্ট ওয়র্কের সমস্ত কাজই বিদ্যালয়ে হলে ছাত্ররা, শিক্ষকের সহায়তায় ছাত্রছাত্রীরা আরও বেশি করে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। এই পদ্ধতি কিন্তু আমাদের দেশের অন্য কিছু রাজ্য ও বিদেশে প্রচলিত আছে। দ্বিতীয়ত আভিভাবকেরা দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হবেন। ছাত্রছাত্রীদের ব্যাগভর্তি করে প্রজেক্ট খাতা ও প্রজেক্ট-এর কাজ বিদ্যালয়ে আনতে হবে না। শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্রের দক্ষতা বিদ্যালয়েই বুঝতে পারবেন এবং মূল্যায়ন করতে পারবেন। সরকারি বা বেসরকারি বিদ্যালয় চার বা পাঁচ তলা হলে সেই বিদ্যালয়ে লিফট বা এসক্যালেটর-এর ব্যবস্থা করতে বাধ্য করাও দরকার। বিদ্যালয়গুলিতে অতি অবশ্যই বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা; যাতে শিশুদের বাড়ি থেকে জলের বোতল আনতে না হয়। এমন বিশেষ ধরনের বইয়ের ব্যাগ ব্যবহার করবে শিশুরা যার ওজন খুবই সামান্য হবে, সেদিকেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
বিভিন্ন বোর্ডের নির্দিষ্ট সিলেবাস-এর বাইরে অতিরিক্ত বই-এর বোঝা যেন ছাত্রছাত্রীদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। আর প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনও ছাত্রছাত্রীই বিদ্যালয়ে বই আনবে না; শুধু মাত্র একটি বা দু’টি ওয়ার্ক বুক নিয়ে আসবে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষেই পড়াশোনা শিখবে।
সরকার পোষিত প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে ব্যাগের ভার এতটা হয় না। তবুও সেই ব্যাগের ভার কমাতে পদক্ষেপ করলে মনে হয় ভাল হবে এবং ছাত্রছাত্রীরা স্বচ্ছন্দে তুলনামূলক ভাবে কম ওজনের ব্যাগ নিয়েই বিদ্যালয়ে আসতে পারবে। দীর্ঘ দিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, প্রতি দিন যে পাঁচ ঘন্টা স্কুল হয়, সেই সময়ের মধ্যে এক ঘণ্টা খেলাধুলোর জন্য বরাদ্দ করে, বাকি চার ঘণ্টায় চারটি বিষয় পড়ানো উচিত। তা হলে শিক্ষক ছাত্রদের মাঝে বেশি সময় ধরে থাকবেন, তাদের সুবিধা অসুবিধা বুঝতে পারবেন, শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের দিয়ে শ্রেণির কাজ করিয়ে নেবেন, আগের দিনের পড়ার বিষয় বোধগম্য হয়েছে কি না তা-ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বুঝে নিতে পারবেন। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদেরও মাত্র চারটি বিষয়ের বই এবং একটি খাতা আনলেই হবে। এতে তাদের ব্যাগের ভার অনেকটা লাঘব করা যাবে এবং সাথে সাথে বিদ্যালয়ে পড়াশোনার মানেরও উন্নতি হবে।
কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকল্পিত দূরদর্শিতার অভাবে শিশুদের প্রাণচঞ্চল শৈশবকে আমরা এক অসুস্থ যন্ত্রণাময় হতাশার জগতে ঠেলে দিচ্ছি। এই ভুল শুধরে নিতে হবে। প্রতি মুহূর্তেই যাদের আমরা শেখাই, মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে; শিশুকাল থেকেই তাদের মেরুদণ্ডে ব্যাগের বোঝা চাপিয়ে, তাদের মাথা তুলে বাঁচার ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছি না তো? তার কাঁধের উপরে যেন সারা পৃথিবীর বোঝা। অথচ বয়স মাত্র দশ কিংবা তারও কম। কত কী যে শিখছে, তার ব্যাগে যে কত বই, কত খাতা! সেই খাতা আর বইয়ের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে ছোটবেলা। আমরা, অভিভাবক ও শিক্ষকরা তা দেখেও দেখছি না।
লেখক শিক্ষক