পশ্চিমবঙ্গকে ‘যুদ্ধকালীন’ ভিত্তিতে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল সরবরাহের নির্দেশ দিয়াছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। আর্সেনিকের সহিত রাজ্যের যুদ্ধ নূতন নহে। ১৯৯৮ সালে আর্সেনিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরামর্শদাতা কমিটি তৈরি করিয়াছিল। সর্বশেষ কমিটি তৈরি হইয়াছে ২০১৭ সালে। সমস্যা তিল পরিমাণও কমে নাই। কেন্দ্রের জলসম্পদ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, রাজ্যের চুয়াল্লিশ লক্ষ মানুষ আর্সেনিকে বিপন্ন। তবে, রাজ্যের বিশেষজ্ঞরা এই পরিসংখ্যানকে বিপদের সম্পূর্ণ চিত্র বলিয়া মনে করেন না। তাঁহাদের মতে, কলিকাতার কিছু অঞ্চল-সহ দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় পানীয় জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছাইয়াছে। বহু মানুষ আক্রান্তও হইয়াছেন। পানীয় জল সম্পর্কে সাবধান হইলেও যে আর্সেনিক-মুক্ত জীবন পাইবেন নাগরিক, এমন নহে। কারণ আর্সেনিক-দূষিত জলের দ্বারা সেচ করিলে, সেই সকল উৎপন্ন শস্য, আনাজ প্রভৃতিতে ওই বিষ প্রবেশ করে, এবং তাহার ক্ষতি করিবার ক্ষমতা যথেষ্ট। বহু বৎসর ধরিয়া বহু বিশেষজ্ঞ আর্সেনিক দূষণ-জনিত জনস্বাস্থ্য সঙ্কটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া আক্রান্তদের হাতে-পায়ে এমন ক্ষত সৃষ্টি করিয়া চলে, যাহাতে শিহরিয়া উঠিতে হয়। বিবিধ প্রত্যঙ্গের ক্যানসার, মহিলাদের প্রজননতন্ত্রে ক্ষতিকর প্রভাব-সহ নানা রোগ ঘটাইয়া থাকে আর্সেনিক। ইহাকে রুখিতে রাজ্যে আর্সেনিকপ্রবণ এলাকাগুলির মানচিত্রও বার বার রচিত হইয়াছে। ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, রাজ্যের আটটি জেলায় অন্তত তিরাশিটি ব্লক আর্সেনিকে ক্ষতিগ্রস্ত।
ভূগর্ভের জলের অপরিকল্পিত এবং অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণেই জলে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব ঘটে। রাজ্যবাসীর বিপন্নতা কমাইতে ভূগর্ভের জলের ব্যবহার কমাইয়া নদী, পুকুর প্রভৃতির জল পরিস্রুত করিয়া পানীয় জল সরবরাহ প্রয়োজন। টিউবওয়েলের ব্যবহার কমাইয়া পাইপবাহিত পানীয় জল পৌঁছাইলে ঝুঁকি কমিতে পারে। কিন্তু এ রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘ দিন পাইপবাহিত জলবণ্টনের ব্যয় অত্যধিক বলিয়া মনে হওয়ায়, জল আর্সেনিকমুক্ত করিবার কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হইয়াছিল। যদিও কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থার একটি রিপোর্ট দেখাইয়াছে, এই প্রকল্পে কাজ হইয়াছে সামান্যই। সম্প্রতি ‘জলস্বপ্ন’ নাম দিয়া গ্রামীণ গৃহস্থালিতে পাইপবাহিত জল সরবরাহ করিবার পরিকল্পনা ঘোষণা করিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাহা যদি বাস্তবিক নদী-পুকুর হইতে সংগৃহীত, পরিস্রুত জল হয়, তাহা হইলে কিছু সমাধান হইতে পারে।
কিন্তু, নদীমাতৃক বাংলার কৃষি নির্ভর করিয়া আছে ভূগর্ভের জলের উপরে। ভূগর্ভের জলের স্তর নামিতেছে, গভীর কূপ খনন করিয়াও পাম্পে জল উঠিতে চাহে না। কিন্তু নদী-নির্ভর সেচ চাষির প্রয়োজনের অতি সামান্যই পূরণ করিতে পারে— গত এক দশকে তাহার কোনও উল্লেখযোগ্য বিস্তারও হয় নাই। বরং বহু গুণ বাড়িয়াছে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার। ভূগর্ভের জল একটি অমূল্য সম্পদ। আর্সেনিক দূষণ তাহার একটি বড় অংশকে ব্যবহারের অযোগ্য করিয়া তুলিবে। যুদ্ধ করিতে হইবে এই ভয়াবহ পরিণামের সহিত। নচেৎ আর্সেনিক কৃষকের জীবিকা ও রাজ্যবাসীর স্বাস্থ্য বিধ্বস্ত করিবে, মারাত্মক ক্ষতি করিবে পরিবেশের।