ক্রমশ ডলফিনদের সংখ্যা ভাবাচ্ছে পশুপ্রেমীদের। ছবি সৌজন্যে: ইন্টারনেট
গঙ্গার শুশুক শান্ত, নিরীহ জলজ প্রাণী। ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও তাদের উপনদী এবং শাখা নদীতে এক সময় তারা স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু আজ তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়েছে। একটা সময় দেখা যেত, গঙ্গার বুকে মাঝেমধ্যেই ভেসে উঠত শুশুক। আবার পরক্ষণেই জলে ডুব দিত। কাটোয়ায় গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে এই সুন্দর দৃশ্য একটা সময় শিশুরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত।
ঘোর বাদামি বা কালো বর্ণের এই প্রাণীটি অবাধে মিঠে জলে ঘুরে বেড়ায়। প্রায় অন্ধ শুশুক পুরুষদের দৈর্ঘ্য দুই থেকে আড়াই মিটার এবং স্ত্রীদের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই মিটার। মাংশাসী প্রাণীটি খাবার হিসেবে মাছ এবং অন্য ছোট জলজ প্রাণীদের ভক্ষণ করে। এদের বিজ্ঞানসম্মত নাম হল ‘প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা’ (দক্ষিণ এশীয় রিভার ডলফিন)। প্রাণীটির নাসারন্ধ্রে একটি নরম মাংসপিণ্ড রয়েছে। এর নাম ‘বার্সা’। এর সাহায্যে এরা শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। এবং ‘ইকো-লোকেশন’-এর মাধ্যমে কোথাও কোনও বাধা রয়েছে কিনা তা জেনে নেয়। কুকুরের ন্যায় তীব্র এদের ঘ্রাণশক্তি। এবং এদের পুরো দেহটি চর্বির আস্তরণে আবৃত। এই আস্তরণ ‘ব্লাবার’ নামে পরিচিত। এর কাজ হল ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করা এবং দেহকে গরম রাখা।
শুশুকের মুখের সামনে রয়েছে একটি লম্বা ‘রস্ট্রাম’ যা তারা ‘ইকো-লোকেশন’-এর কাজে লাগায় ও শিকার ধরে। এরা যখন ভেসে ওঠে তখন বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে ও শ্বাস নেয়। প্রাণীটির চোয়ালে রয়েচে ২৭ থেকে বত্রিশটি ছোট ছোট দাঁত যা আত্মরক্ষা, শিকার ধরার কাজে লাগে।
সামাজিক জোটবদ্ধ জীব এরা। পুরুষ এবং স্ত্রী জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে এবং কখনওই এরা একা থাকে না। কিন্তু বর্তমানে গঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় এদেরকে একা একা ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়টি পশুপ্রেমীদের কাছে এক অশনিসঙ্কেত বহন করে আনছে।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, গত কয়েক দশকে গঙ্গায় শুশুকের সংখ্যা অত্যন্ত কমে গিয়েছে। আইইউসিএন-এর ‘রেড ডেটা বুক’ অনুসারে আজ তারা বিপন্নের তালিকাভুক্ত। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ বা ডব্লিউ ডব্লিউ এফ-এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গঙ্গায় চরম দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য শিকারের কারণে এদের সংখ্যা অত্যন্ত কমে গিয়েছে। সমীক্ষায় আরও জানা যাচ্ছে যে, চোরাশিকারিদের অবাধ বিচরণ এবং যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত বাঁধ তৈরির কারণে এদের সংখ্যা উদ্বেজনক ভাবে কমছে। ব্যাহত হচ্ছে তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া এবং বংশবৃদ্ধি।
সাম্প্রতিক সমীক্ষায় আরও জানা যাচ্ছে, তাদের জন্মহারের থেকে গত কয়েক দশকে মৃত্যুহার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। গঙ্গার শুশুকদের বাৎসরিক মৃত্যুহার ১৫০ থেকে ১৬০। বিহার সরকারের অনুদানে ‘জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’, ‘ওয়াইল্ড লাইফ অব ইন্ডিয়া’ এবং ভাগলপুরের টিলকামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে হাজার কিলোমিটার অঞ্চল বরাবর গঙ্গার শুশুকদের উপরে সমীক্ষা চালানো হয়। এতে প্রায় ১,১৫টি০ শুশুকের সন্ধান মিলেছে। ২০০৫ সালে তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬০০। অথচ ১৯৮২ সালের গণনা অনুসারে দেখা যাচ্ছে এই সময়কালে তাদের সংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। গত শতকের এক সময়ে এই সংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো। এদের সংখ্যা হ্রাসের কারণে জলজ বাস্তুতন্ত্রে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
প্রাণীটিকে সংরক্ষণ করার জন্য আসরে নেমেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, প্রাণীবিদ, পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীরা। ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’-এর মাধ্যমে গঙ্গার জলকে অনেক শুদ্ধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে যাতে এই প্রাণীটির স্বচ্ছন্দে বিচরণ করার মতো পরিবেশ ফিরিয়ে নিয়ে আনা যায়। ‘কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পিসিস’ এই প্রাণীটির বিক্রি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে শুশুক বাঁচানো এবং তাদের বংশবৃদ্ধির হার বাড়ানোর জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভারত সরকার শুশুককে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
১৯৯১ সালে বিহারের বিক্রমশীলায় গড়ে ওঠে ভারতের প্রথম শুশুক অভয়ারণ্য। কহেলগাঁও ও সুলতানগঞ্জের মধ্যে প্রায় ষাট কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা এই অরণ্যে বেশ প্রশংসনীয় কাজ করেছে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং ‘ডব্লিউ ডব্লিউএফ’-এর ভারতীয় শাখা। উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের নারোরা থেকে ব্রিজঘাট —এই বিস্তীর্ণ এলাকা গঙ্গার শুশুক সংরক্ষণের ‘রামসার’ স্থান। রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সরকার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য এই অঞ্চলে শুশুক আজ অনেকটাই নিরাপদ। অদূর ভবিষ্যতে তাদের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তাদের সামর্থ্য অনুসারে যথেষ্টই কাজ করেছে। শুশুকদের উপরে সর্বক্ষণ নজরদারির জন্য গঙ্গার ফরাক্কা থেকে ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলটিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটি হয়েছে রাজ্য সরকার ও ডব্লিউডব্লিউএফ-এর উদ্যোগে। প্রথম ভাগে রয়েছে ফরাক্কা ও ফিডার ক্যানাল, দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে বেলুড় মঠ, বর্ধমান এবং নবদ্বীপ লাগোয়া গঙ্গার অংশ। তৃতীয় ভাগে রয়েছে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, এবং চতুর্থ ভাগে রয়েছে কোলাঘাট অঞ্চল। পঞ্চম ভাগে রয়েছে ডায়মন্ড হারবার ও তার লাগোয়া এলাকা। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী, মৎস্যজীবী ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে শুশুকদের সংরক্ষণের কাজে। তা না হলে কিন্তু পরবর্তী সময়ে গঙ্গার বুকে ভয়াবহ কোনও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আঝাপুর হাইস্কুলের শিক্ষক