—ফাইল চিত্র।
হাইওয়ে ছেড়ে চাষের খেতের কোল ঘেঁষে এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে পৌঁছতে হত সভায়। সাড়ে তিন বছর আগের কথা। সিঙ্গুরের সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে সভা করতে গিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি অধীর চৌধুরী। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে বসিয়ে রাখা হল হাইওয়ে থেকে ভিতরে ঢুকে একটা চায়ের দোকানে! বক্তৃতা সেরে অধীরবাবুর গাড়ি যখন ফেরার পথ ধরেছে, তাঁকে পাশ কাটিয়ে সেই পথেই সভায় পৌঁছলেন ইয়েচুরি।
এ বার করিমপুরে থানারপাড়ার হাটের কাছে সিপিএম প্রার্থীর হাত ধরে সেই অধীরের পাশাপাশিই দাঁড়ালেন পলিটবুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম। একে একে খড়্গপুরে কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচারে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের পাশে দেখা গেল কখনও বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী, কখনও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকে।
সাড়ে তিন বছরে বন্ধুর পথ পেরিয়ে করিমপুর, কালিয়াগঞ্জ, খড়্গপুরে এসে পৌঁছেছে সিপিএম ও কংগ্রেস। লুকোচুরি ছেড়ে সামনাসামনি। আসন সমঝোতা করে তিন কেন্দ্রে উপনির্বাচনে লড়াই হচ্ছে, এক মঞ্চে দু’দলের নেতারা এক সুরেও কথা বলছেন। শুধু সিপিএম নয়, নানা ওজর-আপত্তি ছেড়ে বামফ্রন্টেও জোটের সুর।
বঙ্গের বাম ও কংগ্রেস নেতারা কি ঠেকে শিখেছেন? ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোত্রের আসন সমঝোতা করে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল তাঁরা পাননি। মনের মিলও হয়নি। তখন সিপিএমের রাজনৈতিক লাইন কংগ্রেসের সঙ্গে চলাকে মান্যতা দিচ্ছিল না, দলের বঙ্গ ব্রিগেড রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে কংগ্রেসের হাত ধরেছিল। হায়দরাবাদে গত বছর সিপিএমের ২২তম পার্টি কংগ্রেস বাংলার পথেই সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দেওয়ার পরও সমঝোতার পথ মসৃণ হল না। লোকসভা ভোটের সময় ‘সম্মানজনক শর্ত’-এর প্রশ্ন তুলে জনাচারেক প্রদেশ কংগ্রেস নেতা এমন আপত্তি জানালেন যে, রাহুল গাঁধী থেকে ইয়েচুরি, সকলের চেষ্টা জলে গেল। ফল? বামের বাক্সে সাড়ে ৭% ভোট, কংগ্রেসের ৬%। লাভের গুড় খেয়ে চলে গেল বিজেপি। এ বারের বাম-কংগ্রেস জোট উভয়ের পক্ষেই অস্তিত্ব রক্ষার বাধ্যবাধকতা, নেতাদের ইচ্ছা থাক বা না থাক।
পাটিগণিত বলবে, সাড়ে ৭ আর ৬ মিলে সাড়ে ১৩%— রাজ্য রাজনীতিতে কী আর প্রভাব পড়বে! পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তৃণমূল-বিরোধী ভোটের ভাগ শাসক শিবিরের চেয়ে বেশি। তাই বলে আসন বোঝাপড়া করে লড়ে উপনির্বাচনে হাওয়া ঘুরিয়ে দেবেন, এমন স্বপ্ন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস নেতাদেরও নেই। তাঁরা জানেন, চাকা ঘোরানোর লড়াইটা দীর্ঘমেয়াদি। তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি— এই ধারণা যতটা ঠেকানো যায় ততটাই তাঁদের লাভ। তার জন্য চাই একসঙ্গে পথে নেমে আন্দোলন, অভিন্ন কর্মসূচি। সেটা রাজ্যের পক্ষেও গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি, এই ধারণাই বাস্তবায়িত হয়েছে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরায়। এবং বিরোধী স্বর তো বটেই, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরেই সেখানে তাণ্ডব চলছে প্রতিনিয়ত।
একেবারে নিজস্ব ঘরানার মেরুকরণের সফল প্রয়োগে বিজেপি এ রাজ্যে ভোটে শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে বিপুল। কিন্তু মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে স্থানীয় স্তরে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি এখনও। প্রচারের আলো থাক বা না থাক, নানা বর্গের মানুষের সমস্যা নিয়ে সরব ও সক্রিয় থাকার ক্ষেত্রে বামেরা অনেক এগিয়ে। ভাঙা সংগঠন নিয়েও গত দু’মাসে শুধু জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) বিরোধিতায় বামেদের যত মিছিল, সভা, আলোচনা হয়েছে, যত মানুষকে তারা সংগঠিত করেছে, সেটা তুচ্ছ করা যায় না। অভিন্ন কর্মসূচিতে সীমিত শক্তির কংগ্রেসের আবেগ ও আন্দোলন বাম পরিকল্পনার সঙ্গে ঠিকমতো মিশলে সেই স্রোতের শক্তি বাড়বেই।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাম ও কংগ্রেসের রেকর্ড কতটা স্বচ্ছ, তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে বাম বা কংগ্রেসের তুলনা চলে না। আর, ‘নিখুঁত’ কোনও রাজনৈতিক শক্তি কখনওই থাকে না। সম্ভাব্য বিকল্পগুলির মধ্যে যেটা তুলনায় উন্নত ও নিরাপদ, গণতন্ত্রে তাকেই বেছে নিতে হয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সরিয়ে সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই বাম ও কংগ্রেসের মিলিত বিকল্পের গুরুত্ব।
তর্কটা এড়িয়ে যাওয়ারও কোনও প্রয়োজন নেই। কলকাতায় শহিদ মিনার ময়দানে ১৯৮৯ সালে জনমোর্চার বিজয় সমাবেশে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের হাত ধরে দাঁড়ানো জ্যোতি বসু ও অটলবিহারী বাজপেয়ীর ছবির সৌজন্যে বামেদের আজও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। সে সময়ের কংগ্রেস-বিরোধী প্রায় সব দলের নেতারাই ছিলেন সেখানে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জ্যোতিবাবুই পরে বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে বিজেপিকে ‘অসভ্য, বর্বরের দল’ বলতে দ্বিধা করেননি, বিতর্কের মুখে পিছুও হটেননি। এটাও ভুললে চলে না যে, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কয়েক বছর পরে এ রাজ্যে জোট বেঁধে বিজেপিকে লোকসভা আসন জিততে সাহায্য করার এবং ২০০২ সালে গুজরাতের হত্যাকাণ্ডের পরেও কেন্দ্রের এনডিএ সরকারে থাকার রেকর্ড তৃণমূলের আছে। তেমন কৃতি বামেদের নেই, কংগ্রেসেরও নেই!
সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কংগ্রেসের দোদুল্যমানতার নানা নজির আছে। মোদী-শাহের উগ্র জাতীয়তাবাদ ও কড়া হিন্দুত্বের অভিঘাতে মাঝে মাঝে নরম হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরার মধ্যেও সেই দোলাচলের ছাপ স্পষ্ট। তবু আজকের বিজেপি-আরএসএসের সঙ্গে কংগ্রেসকে এক বন্ধনীতে বসানো যায় না— এই অবস্থান নিতে পেরেছে সিপিএম ও বামফ্রন্ট। জাতীয় স্তরেও বামেরা সঙ্গে থাকলে কংগ্রেসের দোদুল্যমানতা হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তার জনমুখী দিশাও স্পষ্টতর হবে। প্রথম ইউপিএ আমলে যেমন হয়েছিল।
পাটিগণিতকেও তার প্রাপ্য মূল্য দিতে হবে। বাম ও কংগ্রেস জোট বাঁধলে বিজেপির প্রতাপ যে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলেই তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আসনের নিরিখে বড় সাফল্য বাম ও কংগ্রেস পায়নি, কিন্তু বিজয়ী তৃণমূলের সঙ্গে তাদের মোট প্রাপ্ত ভোটের ফারাক গুরুতর ছিল না। আরও বড় কথা, ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে চমকপ্রদ উত্থান ঘটিয়েও দু’বছর পরে বিজেপি নেমে গিয়েছিল তৃতীয় স্থানে। পরে আবার শক্তি বাড়ানোর তাগিদে প্রতিটি সামাজিক পরিসরে, ছোট বড় নানা ঘটনায় বিজেপি অতি তৎপরতায় ক্রমাগত প্রচার করছে, তারাই নাকি দুর্দশা ও অমর্যাদার শিকার সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ত্রাতা হতে পারে, বাকিরা আছে কেবল মুসলিম স্বার্থরক্ষার জন্য। এই প্রচারের ফলে দেশভাগের ক্ষতপীড়িত এই বাংলায় গভীর থেকে আরও গভীরে শিকড় গাড়ছে সাম্প্রদায়িক, বিভাজন-কেন্দ্রিক ভাবনা।
মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন দুটো ধারণা নয়। মেরুকরণের মন্ত্রণা যত প্রবলই হোক, লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে আসন ও ভোটের নিরিখে এত সাফল্য বিজেপি পেত না, যদি শাসক তৃণমূল গত বছর পঞ্চায়েত এবং বিভিন্ন পুরসভার নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে করতে দিত। তারও আগে, তৃণমূল একের পর এক জেলা পরিষদ ও পুরসভার বোর্ড দখল করে, বিধায়ক-সাংসদ ভাঙিয়ে, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মাদক চালান-সহ গুরুতর অভিযোগ দায়ের করে বাম ও কংগ্রেসকে লাগাতার ভাঙিয়ে না চললে বিজেপি পায়ের নীচে দ্রুত শক্ত জমি পেত না। রাজনীতিতে কোনও জায়গাই শূন্য থাকে না। বাম ও কংগ্রেসের নিজস্ব দুর্বলতা ছিলই। কিন্তু তাদের ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ পরিসরকে আরও কোণঠাসা করে ফেলার রাজনীতির পরিণাম হয়েছে গেরুয়া শিবিরের উত্থান। তৃণমূলকে যে মানুষ নানা কারণে সমর্থন করতে চাননি, তাঁরা অন্য বিকল্প না পেয়ে বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন। মেরুকরণের প্রভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে এই বাস্তবতাও।
এ সবের পরে থাকছে জোটবদ্ধ দুই দলের কর্মীদের সহজ আদানপ্রদানের রসায়ন গড়ে তোলার প্রশ্ন। অতীতে মুখোমুখি লড়াইয়ের সময়ে দু’দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রাজনীতির বাজারে ‘চালিয়ে’ দিয়েছিল, যার প্রায় কোনওটারই প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে দেখলে, ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থার বিরোধিতা বামেরা (সিপিআই বাদে) করেছে, আবার তাঁর ব্যাঙ্ক ও খনি জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে সমর্থনও করেছে। এর মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নানা টুকরো। বামেদের ‘সুবিধা’ হল, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানায় বা তারও আগে ‘আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস’-এর শিকার যাঁরা, তাঁরা এখন আর ময়দানে তত প্রাসঙ্গিক নন। তুলনায় বাম জমানায় অত্যাচারিত কংগ্রেস কর্মীদের স্মৃতি টাটকা।
কিন্তু বাম ও কংগ্রেসের সামনে বড় প্রশ্নটা হল, অতীতের কঙ্কাল হাতে নিয়ে কি আরও বিপদের অপেক্ষায় বসে থাকব, না কি বর্তমানের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতের জন্য কোমর বেঁধে তৈরি হব? বৃহত্তর স্বার্থে দ্বিতীয় কাজটাই
করতে চাইছেন দু’পক্ষের নেতারা। তাঁদের এই মনোভাব নীচের তলায় কর্মী মহলে কতটা সঞ্চারিত হবে, তার ওপর নির্ভর করছে বিকল্প জোটের পূর্ণাঙ্গ রসায়নের ভবিষ্যৎ।