ডাল লেক।
যত বার কাশ্মীর গিয়েছি, সময় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পরিচয় ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৩ সালে তখনকার ভারত সরকার কাশ্মীরের প্রাণপুরুষ শেখ আবদুল্লাকে জেলে বন্দি করেছে। জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বক্সি গোলাম মহম্মদ। ওপর ওপর কোনও অশান্তি বুঝতে পারিনি। আমি গিয়েছি শ্রীনগরে বাবার সঙ্গে, নবগঠিত রাজ্য বিধানসভাগুলির স্পিকারস কনফারেন্স উপলক্ষে। বাবা চারুচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অন্যতম সচিব। আমি কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াই, মাঝে মাঝেই ডাক পড়ে, মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ডাকছেন। গিয়ে দেখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ছবি তুলবার জন্য। এক পাশে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার স্পিকার শৈল মুখোপাধ্যায় অন্য পাশে বক্সি গোলাম মহম্মদ। এক বার দেখলাম, সঙ্গে এক অতি সুন্দর তরুণ এবং তাঁর পরমাসুন্দরী স্ত্রীকে। এঁরা হলেন কাশ্মীরের সদর-ই-রিয়াসত রাজপুত্র কর্ণ সিংহ ও তাঁর স্ত্রী, নেপালের রাজকন্যা।
এ দিকে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ বক্সি গোলাম মহম্মদকে অত্যন্ত অপছন্দ করেন। শিকারাওয়ালারা আমাকে বলেন, ‘‘উসনে কাশ্মীর কে লিয়ে কুছ নহি কিয়া।’’ তাঁরা শেখ আবদুল্লাকে ভক্তি করেন। ভারত সরকার তাঁকে বন্দি করেছে, সাধারণ মানুষের মনে গভীর অসন্তোষ। স্পিকারস কনফারেন্সের জাঁকজমকের আড়ালে মানুষের মনে ক্ষোভের আঁচ সেই সময়ে পেয়েছিলাম।
বেশ কিছু কাল পর আবার কাশ্মীরে, সাল ১৯৭৬। সেই সময়ের একটি দৃশ্য মনের মধ্যে আজও জ্বলজ্বল করে। আমি একটি ঘোড়ায় চড়ে গুলমার্গের পথে চলেছি, পিছনে হেঁটে আসছে আমার ঘোড়াওয়ালা, নিতান্ত দরিদ্র, মলিন মুখ, পরনে শতচ্ছিন্ন সোয়েটার। সে আপন মনে বকবক করছে, ‘‘ছিল এক জন, সে যদি আজ থাকত আমাদের দুঃখ বুঝত, এত কষ্ট হত না।’’ আমি মনে মনে জানি সে নিশ্চয়ই তাদের প্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লার কথা ভাবছে। পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, কার কথা বলছ? আমাকে ভয়ানক চমকে দিয়ে সে বলল, ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র।’ বর্তমান গোলমালের সময় বিবিসি-তে যখন দেখলাম কাশ্মীরি জনসাধারণ মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ‘গো ব্যাক গো ব্যাক’ ধ্বনি দিচ্ছে, তখন সেই ঘোড়াওয়ালার মুখটি আবার মনে ভেসে উঠল। একটা রাজ্যসুদ্ধ মানুষকে কী করে বিচ্ছিন্নতাবাদীতে পরিণত করা যায়, তা আমরা দশকের পর দশক ধরে ভুল নীতি প্রয়োগ করে বুঝিয়ে ছাড়লাম। তারা চেয়েছিল ‘একটু দুঃখ বুঝতে পারার হৃদয়’। আমরা তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছি। কেন সে শেখ আবদুল্লার নাম করল না, এ কথা ভেবেছি। শেখ সাহেব বহু দিন বন্দিজীবন যাপন করেছেন, লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। ১৯৭৫ সালে মুক্তিলাভ করে তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। এতে কি তাঁর জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল? তা-ই মনে হয়।
অনেক দিনের ব্যবধানে আবার কাশ্মীরে এলাম। সাল ২০০৩। এ বার এসেছি লোকসভার এমপি হিসেবে আমার নিজের বিদেশ মন্ত্রকের পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে। বিমান থেকে নামামাত্র সিকিয়োরিটির লোকজন আমাদের ঘিরে ফেলল। আমাদের কয়েকটি গাড়ির কনভয় শ্রীনগরের পথে চলেছে, আমার গাড়িটি প্রথম, দেখছি সামনে একটি জিপসি বোঝাই সামরিক বাহিনী আমাদের সুরক্ষার জন্য চলেছে। তাদের বন্দুকের নল তাক করা আছে। পথের দু’ধারে কয়েক ফিট অন্তর দাঁড়ানো সিআরপিএফ। মনে হল যেন কোনও সামরিক অধিকৃত এলাকার মধ্যে দিয়ে চলেছি। অথচ শুনেছিলাম সেই সময়ে মুফতি মহম্মদ সৈয়দের রাজত্বে কাশ্মীর একটু শান্ত। গ্র্যান্ড প্যালেস হোটেলে পৌঁছে দেখলাম সেখানে বেশ কিছু লোকজন, টুরিস্ট রয়েছেন। অথচ জানি ঠিক এক বছর আগেও হোটেল ভূতের বাড়ির মতো খাঁ খাঁ করত, জনমনিষ্যি ছিল না।
মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সৈয়দের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে আমাদের কমিটির একটি বৈঠক হল। আমি এসেছি দেখে উনি কন্যা মেহবুবা মুফতিকে ডেকে পাঠালেন— তার অনেক দিন আগেই মেহবুবা কাশ্মীর সংক্রান্ত একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে কলকাতার নেতাজি ভবনে এসেছিলেন। মোটের উপর একটু শান্তির আবহাওয়া আছে দেখে আমরা মুফতি সাহেবকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। কিন্তু এই শান্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী। শ্রীনগর ছেড়ে আসার দু’এক দিন পরে যেখানে বসে মিটিং করেছিলাম তার কাছেই বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়েছিল।
এক দিন আমরা সকলে শ্রীনগর পাসপোর্ট অফিস পরিদর্শনে গেলাম। বিভিন্ন রাজ্যের পাসপোর্ট অফিস পরিদর্শনে গিয়ে আমাদের কমিটি দেখেছিল প্রায় প্রত্যেকটিতে দুর্নীতির প্রচণ্ড দাপট। অফিসে অপেক্ষারত মানুষজন আমাদের বললেন এখানেও প্রচণ্ড দুর্নীতি ছিল, তবে বর্তমানে এক জন ভারপ্রাপ্ত অফিসার এসেছেন, তিনি খুব ভাল চালাচ্ছেন। এই অফিসারের সঙ্গে অনেক ক্ষণ কথা হল। তিনি এসেছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের সন্ত্রাস-কবলিত এলাকা থেকে। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখে পড়ে গেল, পাসপোর্ট-প্রার্থীদের মধ্যে বসে আছেন কাশ্মীরি কবি আগা শাহিদ আলি-র পিতৃদেব। আগা শাহিদ আলি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আমেরিকায় থাকতেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। কবির পিতা আমেরিকা যাচ্ছিলেন, দিল্লির বিমানবন্দরে তাঁর পাসপোর্ট-সুদ্ধ ওভারকোট চুরি হয়ে যায়। কাজের মানুষ সেই ভারপ্রাপ্ত অফিসার তৎক্ষণাৎ পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেছিলেন বৃদ্ধ আগা আশরাফ আলির জন্য।
শ্রীনগর থেকে কলকাতা ফিরে আসার পর টিভিতে দেখলাম, সন্ত্রাসবাদীরা হামলা করে পাসপোর্ট অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পাসপোর্ট অফিসার আমাকে জানালেন, ‘‘ম্যাডাম, সামান্য কিছু ব্যাকআপ ছাড়া সব কিছু পুড়ে ছাই।’’
পরিশেষে একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করি। কাশ্মীরের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা আমাকে তাঁর বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন। আমার সিকিয়োরিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। এই নেতা প্রাক্তন জঙ্গি কমান্ডার। বিশেষ রকম গোলমেলে এক এলাকায় থাকেন, এলাকাটিকে বলা হয় শহরের ‘গাজ়া স্ট্রিপ’। এক সন্ধ্যায় তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে তাঁর গৃহে নিয়ে গেলেন। আমার সঙ্গে এক জন মাত্র দেহরক্ষী। তাঁর গৃহে প্রবেশ করার মুখে আমার মাথায় পুষ্পবৃষ্টির মতো আখরোট বৃষ্টি হল। দোতলায় কার্পেট পাতা ছোট্ট ঘরটিতে বাড়ির মেয়েরা আমাকে ঘিরে বসলেন, নানা রকম খাওয়াদাওয়া হল। ঘরের কোনায় অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে দাঁড়ানো আমার দেহরক্ষীকে খেতে বলায় সে বললে, ‘‘ডিউটিতে আছি, খেতে পারব না।’’ গভীর রাতে ফের গাড়ি চালিয়ে সেই নেতা আমাকে নিরাপদে গ্র্যান্ড প্যালেস হোটেলে পৌঁছে দিলেন।
আজকের দিনে কোনও ভারতীয় সাংসদ শ্রীনগরের ‘গাজ়া স্ট্রিপ’-এ ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং সাদর আপ্যায়ন পাচ্ছেন, এ তো কল্পনার বাইরে! এখন তো আমাদের নিজেদের সরকারই সাংসদদের শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাচ্ছে, প্রবেশ করতে দিচ্ছে না কাশ্মীর উপত্যকায়।
ভূতপূর্ব সাংসদ