রাজনীতি আমাদের সবটা নিয়ন্ত্রণ করে। আর চোখে কাপড় বেঁধে আমরা খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করি রাজনীতিকে। এই পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল একটা মায়া বা ম্যাজিকের মতো। যার কুয়াশা-টানেল আমাদের চোখের ব্যাপ্তিকে কমিয়ে দিয়েছে। দিনে দিনে আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
আমরা সাধারণ মানুষেরা সামগ্রিক সচেতনতার দিকে এগিয়ে না গিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আর চারপাশের ব্যবস্থা ‘সিস্টেম’ ক্রমে পরিবর্তন হতে হতে এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের শিকার হলেও আমাদের বিরোধিতার সুর ক্রমে কমে আসছে। যদিও এটাই স্বাভাবিক! যাচাই করে বাজার করলেও সামাজিক জীবনে, পারিপার্শ্বিকতায় যাচাই করতে ভুলে গিয়েছি আমরা। দু’চারটে ব্যতিক্রম সব সময় থাকে। তাদের চেঁচিয়ে ওঠাকে আমরাই ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু স্বপ্নেও তাদের পরিস্থিতির মুখোমুখি ভাবতে চাই না নিজেদের।
এত সব জটিল দিককে কোনও এক পাশে সরিয়ে রাখতেই পারি। এর পরও দেখা যায়, আমাদের দেশ জুড়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও অস্থিরতা শুধুমাত্র ভোটকে কেন্দ্র করে হচ্ছে, এমন নয়। আগে ভোটকে কেন্দ্র করে যে অস্থিরতা দেখা যেত, তার উত্তাপ ছড়িয়ে যেত দক্ষিণ থেকে উত্তরে, শহর পেরিয়ে মফস্সলে-গ্রামে, পাড়ায়, চায়ের ঠেকে বা একেবারেই বাড়ির উঠোনে, পারিবারিক আবহে। সে ক’টা দিনের জন্য বিভক্ত হয়ে যেত বন্ধু-পরিবার-স্বজনের চেতনার দিক। রং নিয়ে উন্মাদনা এত ছিল না। রাজনৈতিক তরজা চললেও এক থালায় সান্ধ্য টিফিন চলত, যুক্তির প্রেক্ষিতে উঠে আসত বিপরীত যুক্তি। এতসব রোদেলা বিকেল পেরিয়ে ভোটযুদ্ধের শেষে শান্ত হয়ে যেত সেই সব গ্রাম-মফস্সলের পাড়ার ঠেক বা পরিবার। তখন সেখানে অন্য আবহ। হয়তো তখন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। হয়তো সেখানে বলিউড তরজা। হয়তো হেমন্ত-মান্না।
কিন্তু এখন? এখন চাপা একটা উত্তেজনা, ভিতরে ভিতরে অস্থিরতা। এমনটা ছিল না আমাদের চারপাশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্যিই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তো? ভোটের সময় বা তার আগে থেকে কথা নেই বা পারলে মুখ দেখা বন্ধ করেছে দুই বন্ধু, দুই ভাই, দুই আত্মীয়, দুই স্বজন- এমন ঘটনা অনেক ছড়িয়ে আছে। এটা তো হওয়ার ছিল না। রাজনীতি আমাদের সুস্থ সমাজ গঠনের স্তম্ভ। তাকে ঘিরেও গড়ে ওঠে পরিবার। রাজনীতিকেরা বিভিন্ন দল সামলালেও নিজেদের মধ্যে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। যোগাযোগ রাখেন। সময়ে-অসময়ে পাশে দাঁড়ান শারীরিক ভাবে বা সামাজিক মাধ্যমে। তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই বদলে যায়, বদলে যাবে নিয়ম?
আমরাই তো ভেবে এসেছি যে, পৃথিবীটা একটা ঘর। আমরা কোথাও না কোথাও জুড়ে আছি প্রত্যেকে, একে অপরের সঙ্গে। আমরা একটা যৌথ পরিবার। কোনও এক জোৎস্না রাতে যৌথ যাপনে এক থালায় ভাত খাবার স্বপ্নও দেখছেন হয়তো আমাদেরই কেউ কেউ। মানে, সকলে মিলে বাঁচা। এই সুন্দর পৃথিবীতে স্বল্প আয়ুর জীবন নিয়ে এসে ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ির উপর হইহই করে বেঁচে থাকা একটা জীবনের মাঝে যে ঢিল ছুড়ে দিচ্ছি আমরাই, তা তো দেওয়া উচিত সন্ত্রাসবাদের দিকে। অনৈতিকতার দিকে। সমস্ত অন্যায় অপরাধের দিকে। কু ও কুটিলতার দিকে। তা হলে কেন তা উড়ে আসছে আমাদের বন্ধুর দিকে, আমাদের দিকে? থুতু উপরে তাকিয়ে ছুড়তে নেই, আমরা জানি। এতে নিজের গায়ে এসে লাগে। তারপরও আমরা এই অভ্যাস ছাড়তে পারছি না। আর এর ফলে, হয়তো এই প্রবণতার ফলে খানিকটা হলেও রাজনীতির পরিসরে অসুস্থ রাজনীতি সহজ হয়ে যাচ্ছে। রণনীতি বদলে যাচ্ছে। উন্নয়নের আগে উঠে আসছে উন্মাদনা।
ভারতে আটটি জাতীয় রাজনৈতিক দল এবং অসংখ্য আঞ্চলিক দল আছে। তারাও এগিয়ে এলে শান্তির বাতাবরণে যুক্তির বিরোধিতায়, চিন্তার বিরোধিতায় গণতান্ত্রিক লড়াই হবে। আমরা তো সহজেই ভোটকে যুদ্ধ বানিয়ে দিয়েছি। এরপর যখন আমাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে পরিস্থিতি, তখন ভোটের সঙ্গে মহাযুদ্ধ বসে যাবে। যুদ্ধপরবর্তী স্তব্ধতা নিয়ে যে ভাবে আজকাল বসে থাকছি, হয়তো তার পরিধি বেড়ে যাবে। এ যুদ্ধ তো প্রায় বছরে বছরে বা দু’বছরে একবার লেগেই আছে। স্থূল করে ভাবতে ভাবতে এতে খুব তাড়াতাড়ি সামাজিক অবক্ষয় জুড়ে যাবে। আমাদেরই দোষে। ব্যক্তি, দল নির্বিশেষে শুভচিন্তার উন্মেষের মধ্য দিয়ে যদি বন্ধুত্বের, সম্প্রীতির বাতাবরণ বজায় থাকে, তবেই সুস্থ মানসিকতার পরিচয় দেবে আমাদের ভূভাগ। এই বিশ্বাস করতে মন চায়।
আসলে, বহুদিন আয়নার মুখোমুখি হতে পারছি না। মুখোমুখি হলেই উঠে আসে আত্মশ্লেষ, প্রশ্ন। যার উত্তর সোজাসাপ্টা কিছু নেই, তবু আছে সূত্র। তা ধরে এগিয়ে গেলে বোঝা যায়, আত্মতুষ্টি পেরিয়ে নিজেকে বারবার আঘাত দিয়েই নিজেকে বা নিজেদের বদলানো সম্ভব। প্রত্যেকে যদি নিজেকে বদলাতে চান শান্তির জন্য, তবেই সম্ভব বদল। চিন্তা চেতনার বদল।
লেখক উত্তর খাপাইডাঙ্গা পঞ্চম পরিকল্পনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)