আশ্চর্যভাবে, ১২ মে-র ওই অদ্ভুত অন্ধকার রাতটায়, আচমকাই সুচিত্রা ভট্টাচার্যের চলে যাবার খবরটা টিভির পর্দায় দেখে ফেলার ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে, রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বরের এক সভাগৃহে একটা আলোচনাসভার সাক্ষী ছিলাম আমি। প্রসঙ্গ ছিল মধুশ্রী সেন সান্যালের লেখা মেয়েদের কবিতা: পঞ্চাশ থেকে নব্বই বইটির প্রকাশ। সে সভার সভাপতি শ্রদ্ধেয় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, মেয়েদের কবিতা, পুরুষের কবিতা বলে কিছু হয় না। কবিতা, কবিতাই। কবি, কবি। আমরা কি পুরুষ কবি, বেঁটে কবি, লম্বা কবি, ফর্সা কবি বলি? তা হলে মেয়ে–কবি অভিধাটি কেন?
কেন, সত্যি, কেন? ছোটবেলায় পড়া সেই ‘মহিলা কবি কামিনী রায়’ মনে পড়ল, আর মনে পড়ল, এই ‘মহিলা কবি’ তকমা উঠিয়ে দিতে চেয়েই কবিতা সিংহ রাজলক্ষ্মী দেবীদের চেষ্টা। মনে পড়ল বিজয়া মুখোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র বা নবনীতা দেব সেনদের কব্জির প্রকাণ্ড জোরের কথা। কী কবিতায়, কী গদ্যে, আদৌ ‘মহিলা’ পরিচিতিকে ব্যবহারের কোনও প্রয়োজন হয়নি এঁদের। ক্রমে মল্লিকা-সংযুক্তা-চৈতালী-সুতপা, অন্যদের ঝাঁকে ঝাঁকে কবিতাজগতে আসা, ‘মাইনরিটি’ স্টেটাস ঘুচিয়ে দেওয়ারই লক্ষণ। কবিতার ভাষাও এমনই, যে, কবির নামটি মুছে কাউকে পড়তে দিলে কেউ ভুলেও ‘মেয়েলি’ বলবে না। আর, ‘মেয়েলি’ মানেটাই বা কী? বাসস্টপে দাঁড়িয়ে বিহ্বল আকুল হয়ে জিগ্যেস করা, কোন বাসটা বেথুন কলেজ যায়? যে ন্যাকামিকে অগ্রাহ্য করে কবিতা সিংহ বহুদিন আগেই ‘আটাত্তরের সি ধরে’ সো-জা চলে গিয়েছিলেন?
কিন্তু তবে কেন আলাদা করে আলোচনা, বই লেখা, ‘মেয়েদের কবিতা’ নিয়ে? বেশ খানিক তর্ক উঠেছিল ওই সভায়। নীরেনদা বলেছিলেন, মেয়েদের কবিতা নিয়ে আলাদা করে বই করার আর কোনও যুক্তি নেই, যুক্তি একটাই, মেয়েদের লেখায় এমন এমন সব আলো পড়ে, এমন সব উদ্ভাসে তাঁদের নিজেদের জীবনের কথা উঠে আসে, যা পুরুষেরা লিখতে পারেন না। এই নতুন কথাগুলো শোনা জরুরি, তাই, এঁদের নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে।
সে সভাতেই তার পর কৃষ্ণা বসু বলেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মত। বলেছিলেন, কেন সমাজে মেয়েদের সংরক্ষণ জরুরি। মাতৃরূপিণী দেবীর পূজক সমাজ এখনও মায়েদের মারে, স্ত্রীদের পুড়িয়ে দেয়, কন্যাদের ধর্ষণ করে। মেয়েদের কবিতারও আলাদা করে সংরক্ষণ জরুরি।
আমারও এক ক্ষুদ্র বক্তব্য ছিল সে সভায়। বলেছিলাম, পুরুষ নারী নির্বিশেষে ঠিক যে ভাবে, ‘এক জন বাঘা রাঁধুনির নাম কর দেখি’ বললে আমরা সঞ্জীব কপূরের নাম করি, নিজের মা-ঠাকুমার নাম আমাদের মুখে চট করে আসে না, তেমনই, ‘বিশ শতকের কয়েক জন বড় সাহিত্যিকের বা বড় কবির নাম কর’ বললে এক দুই তিন গুনতে গুনতে আমরা পৌঁছে যাই অন্তত দশ জন কি বারো জন বড় বড় সাহিত্যিকের নামের তালিকায়, অবশ্যই যাঁরা ‘আপতিক ভাবে’ পুরুষ। তার পর হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে আমরা বলি, আর হ্যাঁ হ্যাঁ, মহিলারাও অনেকে খুব ভাল লিখছেন।
মনে পড়ছে দুটো গল্প। এক, নবনীতা দেব সেন একদা বিবৃত করেছিলেন, আশাপূর্ণা দেবীর জ্ঞানপীঠ পাবার গল্প। সেই আশাপূর্ণা দেবী, যাঁকে ‘মেয়েলি গল্প’-এর লেখক বলে এক পাশে ঠেলে রাখা হয়েছিল বছরের পর বছর। প্রলিফিক (বহুপ্রজ) এবং পপুলার (জনপ্রিয়), এই দুটি শব্দের আড়ালে, এক ধরনের নিন্দাব্যঞ্জক স্তুতিময়তায় ঢেকে রাখা হয়েছিল যাঁর সাহিত্যের দার্ঢ্য আর প্রসাদগুণ, সামাজিক চেতনা, তীক্ষ্ণ শ্লেষাত্মক বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে। তীব্র নারী-বয়ানকে। যাকে নারীবাদ বলতে আশাপূর্ণা নিজেই শেখেননি। কিন্তু আজও তাঁর সমসময়ের সমাজে মেয়েদের অবস্থা আর অবস্থানকে চিহ্নিত করতে তাঁর সাহিত্য রয়ে গেছে প্রতিবাদের কষ্টিপাথর হয়ে। আমৃত্যু প্রতিবাদী, ঝলসে ওঠা সেই তাঁর উপন্যাসকে জ্ঞানপীঠ-বিচারকমণ্ডলীর কাছে প্রাথমিক ভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলাটাই ছিল এক কাজ। যে কাজটায় বিশেষ ভাবে অংশ নিয়েছিলেন নবনীতা, আশাপূর্ণাকে অ্যাকাডেমিক গ্রহণযোগ্যতার দিকে আনতেও যথেষ্ট কাঠখড়ের প্রয়োজন হয়েছিল তাই।
দ্বিতীয় গল্প, আমার চোখে দেখা। আর এক সাহিত্য সভা, দশ বা বারো বছর আগের। সে সভায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসু্র মতো জনপ্রিয় বহুপ্রজ লেখকরা উপস্থিত। নিজের লেখালিখির অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে সুচিত্রাদি বলেছিলেন, আমার কাছে এসে অনেক ভদ্রলোক আলাপ করেন। কেউ উকিল কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের মুখে একটাই কথা থাকে, আপনার খুব ফ্যান আমার স্ত্রী, আপনার সব লেখা পড়েছে। একটা সই দেবেন? আচ্ছা, ওঁরা নিজেরাও আমার লেখা পড়েন নিশ্চয়, নইলে এত বিক্রি হয় কী করে? তা হলে স্বীকার করতে কেন লজ্জা?
সবাই যে পড়েন তার প্রমাণ তো শারদ সংখ্যাগুলির কাটতিতেই। সুচিত্রার লেখা উপন্যাস পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন পাঠক, আনন্দমেলায় তিতির মিতিনমাসিও সমান জনপ্রিয় ছিল। অথচ, বলবার সময় কেন এই ভেদরেখা? স্ত্রীগণের পাঠসীমার মধ্যে বাঁধা থাকার জন্যই কি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কলম? না, তিনি প্রতিবাদী নন, জেনে বুঝেই নন। বলতেনও, তোমাদের মতো আমি নারীবাদী নই, আমার স্বামী আমার পুরো সংসার দেখে, ওকে আমি ভীষণ ভালবাসি। কেন রে, পুরুষদের নিন্দে করব? সুচিত্রা জেনেছিলেন, এই পাঠক সমাজে, নারীবাদ এক খারাপ শব্দ। তা পাঠককে দূরে সরায়। তিনি জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন, সচেতন ভাবেই, তাঁর টার্গেট পাঠক রাখতে চেয়েছিলেন সর্বসাধারণকে। অথচ, রেহাই পেলেন না।
কেন, মহিলারা লেখক হলেই তাঁদের টার্গেট গ্রুপ পাঠক হতে হবে দুপুরে ভাতঘুম দেওয়ার আগে পত্রিকার পাতা উল্টেপাল্টে দেখা গৃহবধূ অথবা কলেজ ইস্কুল আপিসে কাজ করা মহিলা? (গৃহবধূদের সংজ্ঞাও দ্রুত পরিবর্তনশীল, ভাত না খেয়ে রুটি খেয়ে বাঙালি গৃহবধূরা এখন নিজেদের বুটিক চালান, এনজিও করেন, জিমে যান, কিটিপার্টি করেন। ভাতঘুম নস্টালজিয়ার বিষয় হয়ে উঠছে!)
যদিচ মেনে নিই, ‘কর্মোদ্যোগী’ পুরুষদের জার্নাল আর গোলাপি কাগজ ( ফিনান্সিয়াল পত্রিকাগুলি) পড়ার পর আর কিছুতে সময় থাকে না, তা হলেও, আবুল বাশার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কেও কি তাঁরা বলতে সাহস পান: ‘আমার স্ত্রী আপনার ফ্যান?’ আকাশের কি টুকরো হয়? সমুদ্রের জলকে কি ভাগ করা যায়?
সুচিত্রা ভট্টাচার্য যে লেখা লিখেছেন এত বছর ধরে, তা কেবল নারীদের জন্য নয়। তাতে নারীদের কথা থাকত, নারীদের জীবনকে, বিশেষত মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত সমাজের জীবনকে ভেতর থেকে দেখা অনেক কথা থাকত। একটি তথ্যেও তিনি ভুল করতেন না। চাকরিস্থলের প্রতিটি খুঁটিনাটি নিজে এক সরকারি সংস্থায় চাকরি করার সূত্রেই জানতেন, খুঁটিনাটিকে কখনও অবহেলা করতেন না— যে কোনও গদ্যকারের যেটা প্রাথমিক শর্ত হওয়ার কথা। ঝরঝরে যে গদ্যটা লিখতেন, অনেক মহান গদ্যকারকেও তা পাওয়ার জন্য মাথা খুঁড়তে হবে। দ্রুত-পড়িয়ে-নেওয়া যে তুমুল জনপ্রিয় গল্প তিনি লিখতেন, আর এক সফল গল্পবলিয়ের যে মুকুট তাঁর মাথায় উঠেছিল, দুটোই অসম্ভব পরিশ্রমের ফল।
তা সত্ত্বেও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সেই স্টিরিয়োটাইপেই বেঁধে রাখার আয়োজন দেখে আমি হতাশ। অনেকেরই চোখে তিনি কেন শুধুমাত্র ‘আশাপূর্ণা দেবীর যোগ্য উত্তরসূরি’? কেন আশাপূর্ণা দেবীকেই বা হতে হবে জ্যোতির্ময়ী দেবী বা প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর উত্তরসূরি? কেন শরৎচন্দ্রের নন? কেন কেন বলা হতে পারে না, সুচিত্রা ভট্টাচার্য বিমল কর, রমাপদ চৌধুরীর যোগ্য উত্তরসূরি?
আমি বলব, সুচিত্রা ভট্টাচার্য বাংলা কথাসাহিত্যের ঘরানায় উজ্জ্বল সংযোজন। একই ধারাবাহিকতায়। যাঁদের গল্প পুনঃপুনঃ চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে সে তালিকার শীর্ষে আছেন সমরেশ বসু। আছেন রমাপদ চৌধুরী। বিমল কর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শংকর। আমরা যেমন ভুলে যাই না, ‘যদুবংশ’ ছবির কাহিনিকার বিমল কর, ভুলি না ‘এখনই’, ‘পিকনিক’, ‘খারিজ’-এর রমাপদ চৌধুরীকে, ভুলব না ‘দহন’-এর সুচিত্রা ভট্টাচার্যকেও। শুধু ‘দহন’ কেন, ‘ইচ্ছে’, ‘অলীক সুখ’, ‘রামধনু’, ‘হেমন্তের পাখি’, অসংখ্য ছবির কাহিনি তাঁর সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে তিনি তাঁর জায়গা রেখেছিলেন দাপটের সঙ্গে। মূলধারার সাহিত্যে, মানুষের মনের কথা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দিয়ে, চিরদিনের গল্প-শুনতে-চাওয়া মানুষের প্রত্যাশা মিটিয়ে, সামাজিক সমস্যাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে, একগোছা লেখা রেখে গেলেন, সবার জন্য। শুধু মেয়েদের জন্য নয়।
শুধু তিনি না, বাণী বসু, পরের প্রজন্মের তিলোত্তমা-সঙ্গীতা-সায়ন্তনীদের পথও এই মূলধারা ধরেই। এক মার্কিন লেখকের সেই কথাটা মনে পড়ে, আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগেই আমরা জীবন সম্বন্ধে যা কিছু জানার জেনে যাই। যুদ্ধ, রক্তক্ষয়, যৌনতা, ভালবাসা, হিংসা, টাকাপয়সা, সব। তবু আমরা সাহিত্যের কাছে যাই কেন? যাই জানা জিনিসগুলোর ওপর টীকা বা ব্যাখ্যা পড়তেই। যাই অন্য এক প্রাজ্ঞতর চোখ, কী ভাবে তাঁর দর্শন, তাঁর জ্ঞান, তাঁর ‘দেখা’ দিয়ে দেখছেন এই জানাচেনা বিষয়গুলো, সেগুলোকেই দেখতে।
ফিরে আসি পুরনো কথায়। কেউ বলতে পারেন, এখানে নারীবাদী প্রসঙ্গ অবান্তর। হলে খুশি হতাম। বলতে পারলে খুশি হতাম যে কথাসাহিত্য, সব–বাদকে আত্মসাৎ করে। বলতে পারলে খুশি হতাম, কথাসাহিত্যিক শেষমেশ বোধ হয় মানবতাবাদী। কিন্তু পারলাম কই? সুচিত্রা ‘মেয়েদের লেখক’, ‘মেয়ে লেখক’ হিসেবে আবার তকমায়িত হলেন। আরও এক বার বলা হল, মূলধারার উচ্চকোটির লেখকদের সঙ্গে এক সারিতে বসবার কথা নয় তোমার। তুমি তো বহিরাগত।
যদিচ, মেয়েদের লেখার অন্য আলো, অন্য অভিজ্ঞতা বার বার পড়তে পড়তে, আশ না মেটা আমার উদযাপন করতে ইচ্ছে করে বার বার ‘মেয়েদের লেখা’ এই বিষয়টিকে, সেই আমিই, মেয়েদের লেখাকে, এক পাশে সরিয়ে রাখার আরও এক বার, বিরোধিতা করছি।