অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ‘বসন্ত’-এ বাজপেয়ীর কবিতা। ফাইল চিত্র।
দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসের দোতলায় আইসিইউ-তে শুয়ে আছেন অসুস্থ অটলবিহারী বাজপেয়ী। অনেকেই আসছেন তাঁকে দেখতে। বন্ধু-মিত্র-পরিজন। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। বারান্দায় দাঁড়িয়েই রাজনীতির কথা হচ্ছে। অনেকে ব্যস্ত স্মৃতিচারণায়। টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে বাজপেয়ীর উদারতা, তাঁর বহুত্ববাদী মানসিকতা নিয়ে চলছে আলোচনা। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই বাজপেয়ী লোকচক্ষুর অন্তরালে। আংশিক পক্ষাঘাত, স্মৃতিভ্রংশ। তবু আজ মোদীজির চার বছর শাসনকাল অতিবাহিত হওয়ার পরেও ৯৩ বছরের অটলবিহারী বাজপেয়ীকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?
কার্ডিয়াক সেন্টারের দোতলায় বসে প্রশ্নটি তুললেন বিজেপির এক প্রবীণ সাংসদ। টাক মাথায় হাত বুলিয়ে জবাবটিও তিনি দিলেন। চার বছরে শাসক দলের অসহিষ্ণুতা আর মারাত্মক আত্মকেন্দ্রিকতায় মানুষটি ক্লান্ত, তিতিবিরক্ত। দলের অন্দরমহলেরই বহু পুরনো মানুষ বলছেন, বাজপেয়ী যুগ থেকে মোদী যুগ— এই গৈরিক বিবর্তন দেখে ভয় হচ্ছে। অখণ্ড ভারতের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তো? ক্ষমতাসীন মানুষ কিন্তু অনেক কিছুই দেখতে পান না। বরং নবাগত স্তাবক আর সভাকবিদের নিরন্তর তোষামোদে মোহান্ধ হয়ে যান শাসক প্রভুরা চিরকালই।
১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ রাষ্ট্রপতি ভবনের বাইরে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অটলবিহারী বাজপেয়ীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ছিলাম। বিজেপি তখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও জোট শরিক ছাড়া সরকার গড়ার ক্ষমতা ছিল না। তাই এনডিএ-র অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির বাঁধনে তখন বন্দি ছিল বাজপেয়ী সরকার। শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছিল রাম মন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা রদ এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো কর্মসূচি। অন্য দিকে ছিল আরএসএস। চাইলেও বন্ধু যশোবন্ত সিংহকে অর্থমন্ত্রী করতে পারেননি অটলবিহারী, আরএসএস-এর ঘোরতর আপত্তিতে।
অটলবিহারী শপথ নিয়েছিলেন প্রথম গ্রীষ্মের সকালে। আর নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রপতি ভবনের বাইরে ২০১৪-র ২৬ মে মধ্য-গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় মহাসমারোহে শপথ নিলেন। আমন্ত্রণ জানানো হল সার্ক সদস্য রাষ্ট্রনায়কদের। ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা। ৪০০০ দর্শক। হাজির দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি। বলিউড তারকা। ধর্মগুরু রামদেব থেকে রবিশঙ্কর। ভাবছিলাম, মোদী আজ এক ইতিহাস রচনা করলেন। কারণ, একক ভাবে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সেই প্রথম। বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটির এক নতুন অধ্যায় শুরু হল।
২০০৪ সালে বাজপেয়ী হেরে গেলেন। আডবাণী এখন স্বীকার করেন, তখন অতি-আস্থায় বাজপেয়ীকে চাপ দিয়ে ছ’মাস ভোট এগিয়ে আনা ওঁর এক মস্ত ভুল। ২০০৪ সালের ভোটের আগে ৭ সফদরজং রোডে প্রমোদ মহাজনের বাসভবনে বিজেপির ওয়র রুম হয়েছিল। প্রমোদ বার বার বলতেন, ক্ষমতায় এসেছিলাম আডবাণীর রথযাত্রায়, কিন্তু আমরা এ বার জিতব, কট্টরবাদ নয়, বিজেপির উদারতা নিয়ে।
দুমদাম মন্তব্য করা আডবাণীর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাজপেয়ীজির সরকারকে মানুষ মনে রাখবে নেহরুর পর সবচেয়ে ভাল কর্মক্ষম প্রশাসনের সরকার হিসেবে।’’ ভোটে হেরে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়েও তিনি বললেন, ‘‘আমরা ভেবেছিলাম সরকারের ভাল কাজের সঙ্গে ভোটের ফলাফলের এক সরাসরি যোগাযোগ আছে। কিন্তু দেখলাম একটা কোথাও যোগাযোগহীনতা ছিল আমজনতার সঙ্গে। আমজনতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার রাজনৈতিক বুদ্ধিও প্রয়োজন ভোটে জেতার জন্য।’’ আডবাণী বলেছিলেন, দরকার ‘প্রুডেন্ট পলিটিক্স’।
এর পর বহু ঘটনার ঘনঘটা। ১৯৯৫ সালে আডবাণীর পাকিস্তান সফর। গোয়ায় জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে নরেন্দ্র মোদীর প্রধান প্রচারক হিসেবে উত্থান। তত দিনে সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির অন্দরমহলে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, বিজেপিকে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ থেকে সরিয়ে উদার ভারতীয়ত্বের পথে নিয়ে যাওয়ার এই চেষ্টাতেই বিজেপির সর্বনাশ রচিত হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘গুরু’র কথিত সেই প্রুডেন্ট রাজনীতিতেই সলতে পাকালেন ২০১৪-র নির্বাচনে। উদার আর্থিক সংস্কার শক্তিশালী অখণ্ড রাষ্ট্র, সুসংহত অনুগত আমলাতন্ত্র, হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি। এক অসাধারণ দক্ষ প্যাকেজ। ভাইব্রান্ট গুজরাত-এর সম্মেলনগুলিতে গিয়েও স্তম্ভিত হয়ে দেখতাম কি সাংঘাতিক ‘ইভেন্ট’। আরও কয়েকটি ঘটনা আপনাদের মনে করাতে চাই। ১৯৮৬ সালে বেকার যুবকদের আকৃষ্ট করার জন্য গুজরাতে বজরং দল তৈরি হল। ২০০৭ সালের মধ্যে আরএসএসের শাখা সংগঠন ভারতীয় কিসান সঙ্ঘ গুজরাতের পটেল সম্প্রদায়কে একত্রিত করল তাদের বিশেষ মর্যাদা দানের আশ্বাসে। তত দিনে গুজরাতে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা হয়ে গিয়েছে দু’কোটি। স্বামীনারায়ণ মন্দিরের দীক্ষিত উপাসক অনুগামীরাও মোদীর পাশে এসে দিলেন এক হিন্দু আইডেনটিটি। নর্মদা নদীর সর্দার সরোবর প্রকল্পের দাবিতে তিনি গুজরাত উপ-জাতীয়তাবাদকেও উস্কে দেন। তার পর গোধরা কাণ্ডের মেরুকরণ। মুসলিম সমাজকে শান্তির বার্তা দেওয়ার জন্য শত উপরোধেও স্কাল ক্যাপ না পরা, এ সবই ছিল সুলিখিত এক চিত্রনাট্য। বাজপেয়ী লখনউতে মুসলমানদের মন জয় করার চেষ্টা করে ধাক্কা খান। আর তা-ই ২০১৪ সালে এক জনও মুসলিম প্রার্থী না করা সঙ্ঘ পরিবার ও মোদী-শাহের রণ-কৌশল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্নীতি বিরোধী ধর্মযুদ্ধ আর তার হাইটেক প্রচার। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হল মোদীর নতুন যুগের ভোর।
তার পর?
তার পর চার বছর অতিবাহিত। এখন দেখা যাচ্ছে গুজরাতের পটেল সমাজ ক্ষুব্ধ। কৃষকরাও ক্ষুব্ধ। চাষির আত্মহত্যা বাড়ছে বই কমছে না। মেরুকরণের রাজনীতি জন্ম দিয়েছে এক অশান্ত কাশ্মীরের। কাশ্মীরে সাংবাদিক হত্যার পর শুধু পাকিস্তান আর মেহবুবাকে দায়ী করলে হবে? মোদী সরকার বা মেহবুবা সরকারের শরিক দল বিজেপির কোনও দায় নেই?
নেহরুর ভারতের মূল বৈশিষ্ট্যের কোনও অ্যান্টিথিসিস রচনা করতে চাননি বাজপেয়ী। তিনি শরিকদের মতামত নিয়ে জোট সরকার চালান। সুপ্রিম কোর্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে দেশের নানান সাংবিধানিক সংস্থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে চাননি। বাজপেয়ীর সঙ্গে কথা বলে মনে হত ‘সংখ্যাগরিষ্ঠবাদ’ আর ‘গণতন্ত্র’-এর ফারাক বুঝতেন। বাজপেয়ী দেশের মৌল কাঠামোটাকে ভেঙে রাতারাতি সঙ্ঘের ভারত নির্মাণে ব্রতী হননি। সংখ্যার জোর তো ছিলই না, বাজপেয়ীর মানসিকতাও ছিল ভিন্ন।
তবে বাজপেয়ী এনডিএ শরিক ও আরএসএস দু’পক্ষকেই খুশি করে চলার চেষ্টা করেন, এ কথা সত্য। কেরলের এক রিসর্টে ছুটি কাটাতে গিয়ে দু’টি প্রবন্ধ সেখান থেকে লিখে পাঠান। ‘মিউজ়িংস ফ্রম কুমারকোম’। তাতে তিনি বাবরি মসজিদ ভাঙার তীব্র নিন্দা করে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে তুলে ধরেন আর সঙ্ঘ পরিবারকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য বলেন, ‘রাম ভারতের এক শ্রদ্ধেয় জাতীয় সত্তার প্রতীক। রামের প্রতি শ্রদ্ধা দেশের সব সঙ্কীর্ণতার বেড়া ভেঙে দেয়।’ হয়তো এতেও রাজনৈতিক কৌশল ছিল, কিন্তু অন্যের মতের প্রতি কোনও বিদ্বেষ ছিল না।
আজ এত বছর পর গোটা দেশে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ভিন্ন মত বলে কিছু হতেই পারে না। হয় আপনি আমার বন্ধু, নয়তো শত্রু। বুশ যেমন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আপনি কোন দিকে?’’ বন্ধু মানে নিঃশর্ত আনুগত্য। বাজপেয়ী যুগটাও বিজেপিরই। তবু সে দিন ভিন্ন মত প্রকাশের উপর রাষ্ট্রীয় নিন্দার শিকার হতে হয়নি।