সঙ্কটাপন্ন: দেশ জুড়ে বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদীরা নিরাপত্তাহীনতার শিকার, নাগরিকত্ব আইনবিরোধী বিক্ষোভ, আলিগড়, ৬ জানুয়ারি। পিটিআই
নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী বা সিএএ ১০ জানুয়ারি গেজ়েটে বিজ্ঞাপিত হল অর্থাৎ সরকারি ভাবে চালু হল। কৌতূহলের বিষয়, তার পাঁচ দিন আগেই উত্তরপ্রদেশ সরকার ঘোষণা করে, তারা আইনটি কার্যকর করতে শুরু করেছে। জেলাশাসকদের বলা হয়েছে (একটি রিপোর্ট অনুসারে কেবল মৌখিক ভাবে) এই আইনে উপকৃত ব্যক্তিদের, অর্থাৎ নির্দিষ্ট তিন দেশ থেকে আগত ছ’টি ধর্মের ‘শরণার্থী’দের, শনাক্ত করতে; সেই সঙ্গে সপ্তম যে ধর্মটি ছাড় পাচ্ছে না, তার ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ চিহ্নিত করতে।
খবরটা একাধিক কারণে মুগ্ধকর। প্রথম কারণ সরকারের অসাধারণ তৎপরতা, আইন বলবৎ হওয়ার আগেই কর্মকাণ্ডের সূচনা। মনে রাখবেন, একই রাজ্যে উন্নাওয়ের ধর্ষিতা রমণীর অভিযোগ খাতায় তুলতে পুলিশের দশ মাস লেগেছিল।
আরও বড় প্রশ্ন: সিএএ এমন কী ব্যাপার যে সরকারের আগ বাড়িয়ে সমীক্ষা চালাতে হবে? আইনটির সঠিক প্রয়োগে উপকৃত হবেন সারা ভারতে বড়জোর কয়েক লক্ষ মানুষ (বর্তমান সরকারি হিসাবে মাত্র ৩১,৩১৩ জন)। ধরা যায়,
এঁরা নিজেদের স্বার্থে নিজেরাই নাগরিকত্বের আবেদন করবেন। এই অল্পসংখ্যক প্রার্থীর জন্য রাজ্য বা দেশ জুড়ে বিশাল ব্যয়বহুল সমীক্ষা সরকার কেন চালাবে?
তবে কি দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটাই প্রধান, অর্থাৎ ‘বেআইনি’ মুসলিম বাসিন্দাদের চিহ্নিত করা? এই যে শুনছি সিএএ কারও ক্ষতি করবে না, কাউকে দেশচ্যুত করবে না? সিএএ-র সীমিত প্রয়োগে তেমন না হতে পারে, কিন্তু আইনটা উপলক্ষ করে কর্তারা আরও ব্যাপক অভিযান চালাতেই পারেন, এনপিআর বা এনআরসি হলে তো কথাই নেই। অতএব শাসকেরা যতই বোঝান আইনের আক্ষরিক বয়ান দেখে নিশ্চিন্ত থাকতে, দুইয়ে দুইয়ে দশ না করতে, বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তব (সর্বোপরি শাসকদের আলটপকা পরস্পরবিরোধী উক্তি) অগ্রাহ্য করি কী করে? যত অভয়বাণী উচ্চারিত হচ্ছে, ব্যাপারটা তত গুলিয়ে গিয়ে ভীতি ও বিভ্রান্তি বাড়ছে কেবল।
আসল কথা, সিএএ এনআরসি এনপিআর বা অন্য হাজার সূত্র ধরে নাগরিকত্বের জিগির তোলা যায়। সে ক্ষেত্রে দেশের যে কোথাও গরিব ও অল্পশিক্ষিত মানুষ তো বটেই, শিক্ষিত সচ্ছল লোকেও প্রায়ই নথিপত্র দেখাতে পারবেন না—বিশেষত যদি সরকার উঁচিয়ে থাকে খুঁত ধরা বা বাতিল করার জন্য। এ ভাবে কত সাচ্চা নাগরিক বরবাদ হয়ে যাবেন কেউ জানে না; তাঁরা একটি বিশেষ ধর্মের হলে শাসকগোষ্ঠী উল্লসিত হবেন বরং। এমনিতেই এই ধর্মাবলম্বীদের ঘন ঘন নিদান দেওয়া হচ্ছে পাকিস্তান চলে যাওয়ার জন্য।
দেশের সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন বঙ্গভাষী মুসলিমেরা।
উত্তরপ্রদেশে সযত্নে গড়ে তোলা হচ্ছে এই পরিস্থিতির এক মডেল বা পূর্বাভাস। সারা দেশে সিএএ-আন্দোলনে হত হয়েছেন ২৬ জন, তার ১৯ জন উত্তরপ্রদেশে (বাকিরাও সকলে বিজেপি শাসিত রাজ্যে)। ব্যাপক নৃশংস গ্রেফতার-অত্যাচার, পুলিশি হামলা ও ভাঙচুরের বিবরণে কেবল আমরাই শিউরে উঠছি না, উত্তরপ্রদেশের মানবাধিকার কমিশন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তদন্ত করছে; জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও সক্রিয়, সক্রিয় ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগে কিছু ব্যক্তির কাছে ‘ক্ষতিপূরণ’ চাওয়া হয়েছে— তাঁদের এক জন প্রয়াত, দুই জনের বয়স নব্বইয়ের উপর, সুতরাং অন্য নামগুলো নিয়েও সন্দেহ উঠতে বাধ্য। ক্ষতিপূরণ দাবি করা হচ্ছে উচ্চ আদালতের নির্দেশ দেখিয়ে, কিন্তু আদালতের নির্দিষ্ট পদ্ধতি বিন্দুবিসর্গ মানা হচ্ছে না। পুলিশের বিরুদ্ধে যে বেপরোয়া ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ, তার ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন ওঠেনি বলা বাহুল্য।
এক কথায় সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে, একটি ধর্মের মানুষ ও তাঁদের সহমর্মীদের মনোবল ও আত্মসম্মান এত চরম ভাবে ভেঙে দিতে, বৈষয়িক ভাবেও এত ক্ষতিগ্রস্ত করতে, যে তাঁরা আর কোনও দিন মাথা তুলতে না পারেন। সিএএ-র বিধানে এমনিতেই তাঁরা বাকি দেশবাসীদের থেকে আত্মিক ভাবে বিচ্ছিন্ন— বার্তা গিয়েছে, ভারত তাঁদের স্বভূমি নয়, নেহাত তাড়ানো না গেলে ক্ষমাঘেন্না করে ঠাঁই দেওয়া হবে। যদি আইনের কূট বিচারে সিএএ আদালতের অনুমোদন পেয়েও যায়, নীতিগত ভাবে তা যে সংবিধানের— এবং ভারতের অভ্যস্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আবহের— মৌলিক সর্বজনীন মানবিকতার বিরোধী, তাতে সন্দেহ নেই।
একটা ব্যাপারে তাই সতর্ক না হলেই নয়। সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে দেশ জুড়ে সব শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মানুষ শামিল হয়েছেন। একটা চিন্তাকর প্রবণতা কিন্তু দেখা যাচ্ছে: জনগণের দৃষ্টি উত্তরোত্তর নিবদ্ধ হচ্ছে বড় শহরের কয়েকটি ঘটনা ও প্রসঙ্গে। এগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই। জেএনইউয়ের ঘটনায় আমরা সঙ্গত ভাবেই আতঙ্কিত, যদিও সিএএ-র সঙ্গে তার যোগ নেই, সিএএ থেকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিচ্ছে বরং। (হামলাকারীদের কি সেটাই উদ্দেশ্য ছিল?) শাহিনবাগ বা পার্ক সার্কাসে সাধারণ ঘরের মহিলাদের প্রতিরোধে আমরা অনুপ্রাণিত। কিন্তু বাকি দেশের খোঁজ নেওয়া, তার মানুষজনের পাশে দাঁড়ানোর কী হল? ভাবুন তো, গত দু’হপ্তায় মহানগরগুলির বাইরে অন্যত্র প্রতিবাদ-আন্দোলন-উৎপীড়নের ক’টা খবর পড়েছেন, টিভিতে ক’সেকেন্ড সম্প্রচার দেখেছেন? সমাজমাধ্যমেই বা ক’টা পোস্ট দেখেছেন বা নিজে লিখেছেন?
মুম্বই আর মাইসুরুতে (বিশেষত বিজেপি শাসিত মাইসুরুতে) যে দু’টি তরুণী কাশ্মীরমুক্তির পোস্টার তুলে ধরেছিল, তারা কেমন আছে? উত্তরপ্রদেশ থেকে বিরল রিপোর্টের একটিতে যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন তাঁর রাজ্যে এখন সব ঠান্ডা, যারা আগে গন্ডগোল পাকাচ্ছিল তারা ক্ষমাভিক্ষা করছে। কারণটাও তিনি সদর্পে ঘোষণা করেছেন: ক্ষতিপূরণ দাবির উপরোক্ত কৌশল। এমন শান্তিবার্তায় আমরা আশ্বস্ত হব কি? আদিত্যনাথের দাবি যদি সত্যি হয়, দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যের একটা বিশাল গোষ্ঠী কত দূর নিপীড়িত হলে, কতটা হতাশ অসহায় নির্বান্ধব বোধ করলে রাতারাতি এ ভাবে আত্মসমর্পণ করতে পারে?
একটা প্রশ্ন খুব জরুরি: সত্যিই কি ছোট শহরে, মফস্সলে এই নাগরিক আন্দোলন গতি হারাচ্ছে? যদি হয়, সে জন্য মহানগরবাসীদের আত্মসর্বস্বতা কতটা দায়ী? ছোট জায়গায় এমনিতেই লোকবল কম, প্রচার কম, উৎসাহ বজায় রাখা কঠিন; দমনের খাঁড়া নেমে আসে অনেক দ্রুত, বহির্বিশ্বের অগোচরে। জেএনইউয়ের ঘটনায় আমরা যখন মশগুল, ধর্মতলার সমাবেশে উজ্জীবিত, বাকি দেশ থেকে কি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি? তা-ই যদি হয়, আমরা দু’একটা বিক্ষিপ্ত উদ্যোগে মজে বৃহত্তর সংগ্রামের খেই হারিয়ে ফেলছি, ‘ব্যাটল’ জেতার উত্তেজনায় ‘ওয়ার’-এর সাফল্যকেই বিপন্ন করছি।
আজকের আন্দোলন দেশ জুড়ে শ্রেণি-শিক্ষা-জাত-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিচারে ভারতবাসীর সম্মিলিত প্রয়াস, এতেই তার শক্তি। বিশেষত সমাজের কিছু সদানীরব নেপথ্যচারী গোষ্ঠী (যেমন সাধারণ ঘরের মুসলিম মহিলারা) যে নতুন আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর, তার মূল্য অপরিসীম; সকলের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, শাসকের কাছে মস্ত চ্যালেঞ্জ। দলীয় রাজনীতির ছায়াযুদ্ধের বাইরে সাধারণ নাগরিকশক্তির মোকাবিলায় শাসককুল অভ্যস্ত নন। এই দেশব্যাপী নাগরিক মেলবন্ধন যে কোনও মূল্যে ধ্বংস হলে তাঁদের স্বস্তি। সেই সুযোগ যেন আমরা তাঁদের হাতে না তুলে দিই। ফিরে না যাই সেই চিরাচরিত অবস্থানে, যেখানে সরব শিক্ষিত শহরবাসীরা তাঁদের গোষ্পদকেই সাগর ভাববেন, বাকি দেশবাসী তলিয়ে যাবেন নীরব অসহায়ত্বের অতলে। এ বার যেন সত্যিই সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে; মোড়ের মাথার হট্টগোলে তা চাপা পড়ে না যায়।
এই নতুন-পাওয়া নাগরিক একাত্মবোধ বড় দামি, বড় আদরের— আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার মতো নাগরিক জীবনের একমাত্র চাবিকাঠি। কিন্তু তা এখনও আছে উচ্ছ্বাসের পর্যায়ে; ভঙ্গুর, ক্ষীণজীবী। সেটা আগলে রাখার, পুষ্ট করার দায়িত্ব আমাদের সকলের, কিন্তু অবশ্যই খানিক বেশি মাত্রায় আমাদের উপর যাদের অবস্থান কিছুটা সুবিধাজনক, শিক্ষা, অর্থ, শ্রেণিগত প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি যারা কমবেশি উপভোগ করছি। এই বৃহত্তর দায়িত্ব ভুলে আমরা যেন অজান্তে শ্রেণিস্বার্থের গহ্বরে ফিরে না যাই। সত্যিই যেন আপন হতে বাহির হয়ে, সকলে একসঙ্গে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতে পারি।
এমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়