Joe Biden

সভ্যতার সন্ধানে

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কৌশলটি বিতর্কসভায় প্রয়োগ করিয়াছেন, যে কৌশলের প্রয়োগবিদ্যায় ইতিমধ্যেই তিনি অবিসংবাদিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তাহার স্বরূপ বুঝিয়া লইবার বিশেষ প্রয়োজন আছে, কারণ প্রথমত তাহা ভয়ঙ্কর এবং দ্বিতীয়ত তাহার প্রাদুর্ভাব দ্রুত বাড়িতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২০ ০২:৪২
Share:

ছবি: এএফপি।

শেষ অবধি জো বাইডেন বলিতে বাধ্য হইয়াছেন: উইল ইউ শাট আপ, ম্যান। ভদ্রসমাজে এই কথা বলিবার রীতি নাই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এই উক্তি না করিলেই ভাল হইত। তিনি নিজেও নিশ্চয়ই তাহা জানেন। বাইডেন কোনও মহান রাজনীতিক নহেন, কোনও বিষয়েই কোনও অসাধারণত্বের দাবি তিনি করিতে পারিবেন না, অতি বড় ডেমোক্র্যাট সমর্থকও মানিবেন যে, তিনি বড়জোর পিটুলিগোলা। কিন্তু সমস্ত দোষত্রুটি লইয়াও তিনি শেষ অবধি এক জন রক্তমাংসের মানুষ। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে সেই কথা একই অর্থে বলা শক্ত। জীববিজ্ঞানের হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শরীর রক্তমাংসেই গড়া। কিন্তু— দুনিয়া সাক্ষী— তাঁহার আচরণ তাঁহাকে কেবল রাজনীতিকদের মধ্যেই স্বতন্ত্র করে নাই, ‘ভিন্ন প্রজাতির মানুষ’ আখ্যাটিকে একটি বিশেষ অর্থ দিয়াছে। তাঁহার গুণাবলির তালিকা রচনার আজ আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ভাবে অভদ্রতা করিবার এবং মিথ্যা বলিবার অসামান্য ক্ষমতাটির উল্লেখই আপাতত যথেষ্ট, কারণ আমেরিকার নির্বাচনী প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ টেলিভিশন বিতর্কমালার প্রথম আসরে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই ‘স্বকীয়’ অস্ত্রটিই প্রয়োগ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাকে কার্যত কোনও কথাই বলিতে দেন নাই, যুক্তি ও তথ্যের কিছুমাত্র পরোয়া না করিয়া ক্রমাগত বিরক্ত করিয়াছেন এবং তাহার অনেকটাই নিছক ব্যক্তিগত আক্রমণ। বিতর্কসভা সঞ্চালনাকারী প্রবীণ সাংবাদিক অচিরেই হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন, বাইডেন কিছুক্ষণ তর্ক চালাইয়া যাইবার, এবং মাঝে মাঝে ঢিলের জবাব পাটকেলে দিবার ব্যর্থ চেষ্টার পরে বলিয়াছেন: আপনি মুখ বন্ধ করিবেন? বলা বাহুল্য, এতৎসত্ত্বেও মুখ বন্ধ হয় নাই।

Advertisement

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কৌশলটি বিতর্কসভায় প্রয়োগ করিয়াছেন, যে কৌশলের প্রয়োগবিদ্যায় ইতিমধ্যেই তিনি অবিসংবাদিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তাহার স্বরূপ বুঝিয়া লইবার বিশেষ প্রয়োজন আছে, কারণ প্রথমত তাহা ভয়ঙ্কর এবং দ্বিতীয়ত তাহার প্রাদুর্ভাব দ্রুত বাড়িতেছে। এক কথায় বলিলে, তাহা অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক করিয়া তুলিবার কৌশল। সভ্য সমাজে গত কালও যাহা ‘হইতে পারে না’ বলিয়া সাব্যস্ত ছিল, এমন অনেক কিছু দেখিতে দেখিতে ‘চলতা হ্যায়’ হইয়া উঠিতেছে। ট্রাম্প এই প্রবণতার চরমতম দৃষ্টান্ত এবং প্রধানতম নায়ক হইতে পারেন, কিন্তু দুনিয়ার দিকে দিকে প্রবণতাটি অতিমাত্রায় প্রকট, এবং সাম্প্রতিক ভারত একেবারেই সেই দুনিয়ার বাহিরে নহে। মিথ্যা কথা, গালিগালাজ, কথায় কথায় প্রতিপক্ষকে হিংস্র আক্রমণ, ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা পরিচিতিগত কুৎসা— অনৈতিক অশালীনতার সমস্ত সম্ভাব্য প্রকরণ এখন যথেচ্ছ ব্যবহৃত হইতেছে। রাজনৈতিক বক্তৃতা, টেলিভিশন চ্যানেলের ‘আলোচনাসভা’, সমাজমাধ্যমের অনন্ত আদানপ্রদান, যে কোনও পরিসরে আক্ষরিক অর্থেই প্রতি দিন চলিতেছে চূড়ান্ত মাত্রায় অভদ্র এবং অশোভন অসহিষ্ণুতার প্রদর্শনী। রাজনীতির ক্ষমতাবানেরা এই কদর্যতার প্রধান উৎস, কিন্তু রাজনীতির বাহিরেও, বিনোদনের দুনিয়া হইতে শুরু করিয়া সংস্কৃতির ভুবনে, এমনকি শিক্ষাবিদদের পরিসরেও ব্যাধির প্রকোপ ক্রমশ বাড়িতেছে।

অতঃপর? এই নরকযাত্রাকে প্রতিহত করিবার উপায়? যুক্তি ও তথ্য দিয়া এই কদর্যতার সহিত লড়াই করা অসাধ্য, কারণ তেমন ধর্মযুদ্ধের ন্যূনতম শর্তগুলিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়াই ইহার কারবারিরা ময়দানে নামে। আবার, ইহাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া চলাও কার্যক্ষেত্রে কঠিন, তাহার কারণ— এই কারবার বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগীর অপকর্মে সীমিত নহে, ক্ষমতাবানেরা ইহার কলকাঠি নাড়িতেছেন, তাঁহাদের মধ্যে ট্রাম্পের মতো রাজনীতিক বা রাষ্ট্রযন্ত্রীরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন বিবিধ সংবাদমাধ্যমের পরিচালকরাও। জনমনে তাঁহাদের প্রভাব, যত দুঃখজনকই হউক, কম নহে। সুতরাং, অন্ধ হইয়া থাকিলে প্রলয় বন্ধ করা যাইবে না। সদুপায় একটিই। সুষ্ঠু ভাবে, সংগঠিত উপায়ে ইহাদের মিথ্যার আবরণ উন্মোচন করা এবং দৃঢ় ও সংযত ভাবে যুক্তি ও তথ্য দিয়া সত্য প্রতিষ্ঠায় নিরলস থাকা। ট্রাম্পদের সহিত তর্কে শক্তি ও সময়ের অপচয় না করিয়া নাগরিক সমাজের সহিত কথোপকথন জারি রাখিবার কাজটি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হইতে পারে। কাজটি সহজ নহে, তবে তাহা অসম্ভব বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। সমস্ত মানুষ অনন্ত কাল মিথ্যা এবং হিংসার পাঁচন গিলিয়া চলিবেন, এমন কথাই বা ধরিয়া লওয়া হইবে কেন?

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

ডোনাল্ড ট্রাম্প কি সুস্থ হওয়ার পর নাকখত দিয়ে স্বীকার করে নেবেন, কোভিড নিয়ে অ্যাদ্দিন যা বলেছিলেন, সবই বিশুদ্ধ প্রলাপ? অনেকেই সন্দেহ করছেন, তেমন কিছু হবে না, বরং দিন পনেরো পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে বলবেন, “ধুস, এই তো আমারও হল। দু’চারটে হাঁচি, একটু সর্দি, এর বেশি কিস্যু না। কোভিডের ভয় দেখিয়ে আমাদের ঘরে আটকে রেখে ওরা আসলে সব কাজ চিনে পাঠিয়ে দিতে চায়।” ঘরের ভোট সামলাতে বিদেশি শত্রুর গল্প, এ তো আমাদের কতই চেনাজানা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement