সম্মান: মোহবনি গ্রামে ক্ষুদিরাম বসুর মূর্তি। নিজস্ব চিত্র
তেমন কোনও তথ্য মেলে না ঊর্মিলাবালা পড়িয়া সম্পর্কে। অথচ এই ঊর্মিলাবালাই স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রথম মহিলা শহিদ। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরে মোহবনি গ্রামে ক্ষুদিরামের পৈতৃক ভিটা। সেই গ্রামের কাছেই একটি গ্রাম হল খেতুয়া। এই গ্রামেই জন্ম ঊর্মিলাবালার।
ঊর্মিলাবালা ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। গ্রামের মহিলাদের সংগঠিত করে লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়েই ঘটে যায় পিংলার ঘটনা। ১৯৩০ সালে ১১ জুন পিংলার ক্ষিরাই নামে এক গ্রামে আন্দোলনকারীদের উপরে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। তাতে ২২ জন শহিদ হন। আহতদের কয়েকজনও পরে মারা যান। সেই ঘটনার প্রতিবাদে পুরো মেদিনীপুর জ্বলে ওঠে। মহিলারা প্রতিবাদে সামিল হন। ঊর্মিলাবালা এই ঘটনার পরে ব্যাপক ভাবে ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলন শুরু করেন। বহু মহিলাকে একত্রিত করে কেশপুর থানায় অভিযান চালান। পুলিশ ঊর্মিলাবালার কাজকর্ম সম্পর্কে আগেই জানত। সেদিন থানায় প্রবল লাঠি চালায় পুলিশ। যেহেতু উনি নেত্রী তাই ওঁকে প্রবল ভাবে মারা হয়। সেইদিনই মারা যান ঊর্মিলাবালা।
জেলার প্রথম শহিদের মৃত্যুর দিনটি জানা যায় না। তবে জুন মাসের শেষ সপ্তাহে মারা গিয়েছিলেন। জেলার প্রথম শহিদ সম্পর্কে এর বেশি তথ্য মেলেনি। তবে তাঁর কিছুটা পরিচয় উদ্ধার করা গিয়েছে। তাঁর স্বামীর নাম মৃগেন্দ্রনাথ পড়িয়া। খেতুয়ায় পাঁজা পদবিধারী এক পরিবারের বাস ছিল। তাঁদের নামে এখনও রয়েছে পাঁজা পুকুর। এই পরিবারের এক মেয়েকে দাসপুরের কোনও এক পড়িয়া যুবক বিয়ে করেছিলেন। দরিদ্র সেই যুবক পাঁজাদের ঘরজামাই হন। পরে পাঁজাদের বংশ লোপ পায়। টিকে থাকে পড়িয়াদের বংশধরেরাই। ঊর্মিলাবালার বংশধর সর্বরঞ্জন পড়িয়া ওঁর ছেলে সুকুমার পড়িয়া।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিভক্ত মেদিনীপুরের ছ’জন মহিলা শহিদের নাম পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে দু’জনই কেশপুরের। একজন ঊর্মিলাবালা। অন্যজন শশিবালা দাসী। স্বাধীনতা সংগ্রামে কেশপুরের বাসিন্দা চারজন পুরুষেরও প্রাণ গিয়েছিল। শশিবালা ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহিদ হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল রাসবিহারী পাল ও হরিপদ মাইতির লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ (তৃতীয় খণ্ড) বইয়ে শশিবালার শহিদ হওয়ার প্রসঙ্গ বিস্তারিত ভাবে জানা যায়। অগস্ট আন্দোলনের ঘটনা। বন্দুক ছিনতাই হয়েছিল ব্রিটিশ সেনার। সেই বন্দুক উদ্ধারে মরিয়া ছিল ব্রিটিশ পুলিশ। সেদিন ১৯৪২ সালের ১১ নভেম্বর ভোর রাত। গোরা সেনাদের ছিনতাই হওয়া বন্দুক উদ্ধার করতে কেশপুরের তোড়িয়া গ্রামটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। হালকা শীতের আমেজে ঘুমে আচ্ছন্ন তখন পুরো গ্রাম।
পরিকল্পনামাফিক গ্রাম ঘিরে শূন্যে গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তোড়িয়ার বাসিন্দাদের। হতচকিত হয়ে যান গ্রামবাসীরা। তার পরেই প্রাণ বাঁচাতে ঘর ছেড়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেন। পুলিশও সেই সুযোগ কাজে লাগায়। এবার প্রাণভয়ে পালানো মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে ব্রিটিশ পুলিশ। পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন শশিবালা দাসী-সহ গ্রামের তিনজন বাসিন্দা। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ১৪ বছরের কিশোর রামপদ ঘোষ এবং ৩৭ বছরের যুবক পঞ্চানন ঘোষের। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হন গৌর বাগদি, গেঁড়া ঘোষ, কালোসোনা ঘোষ-সহ তোড়িয়া গ্রামের আরও কয়েকজন বাসিন্দা। তাঁদের চিকিৎসার জন্য এলাকার চিকিৎসক সুধাকৃষ্ণ বাগ সচেষ্ট হলে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকেও বাধা দেন। কার্যত বিনা চিকিৎসাতেই থাকেন গুলিবিদ্ধ গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামে সেদিন হাহাকার অবস্থা। তবুও রেহাই মেলেনি। ব্রিটিশ প্রশাসনের নির্দেশে চলে ব্যাপক ধরপাকড়।
পুলিশ তোড়িয়া-সহ আশেপাশের এলাকার একশো জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করে। তাঁদের কড়া প্রহরায় পুলিশ কিছুটা দূরে কেতুয়া গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে চলে নির্মম পুলিশি অত্যাচার। এমনকি কেতুয়া গ্রামের মহিলারাও এই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাননি। কেন ব্রিটিশ পুলিশের এত আক্রোশ? কেশপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তোড়িয়া গ্রাম ব্রিটিশদের অত্যাচার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল। গোরা সেনাদের বন্দুক ছিনতাইয়েও যুক্ত ছিলেন এই গ্রামের কয়েকজন। তারই বদলা হিসাবে তোড়িয়া গ্রাম বিদেশি শাসকের রোষানলে পড়ে। কখনও গ্রাম ঘিরে গুলি চলে। কখনও ব্রিটিশ পুলিশের ব্যাপক লুঠতরাজের শিকার হন গ্রামের বাসিন্দারা।
শুধু তোড়িয়াই নয়, বিয়াল্লিশের আন্দোলনে কেশপুর থানার আরও কয়েকটি গ্রামেও বিদ্রোহ শুরু হয়। এইরকমই একটি গ্রাম হল রানিয়াড়। অভাব-অনটনে জর্জরিত এই গ্রামের বাসিন্দারা স্থানীয় এক জমিদারকে খাদ্যাভাবের কথা জানায়। কিন্তু জমিদার তাতে কান দেননি। বাসিন্দারা জমিদারের ধানের গোলা দখল করে। জমিদার কেশপুর থানায় অভিযোগ জানালে দারোগার নেতৃত্বে কয়েকজন সিপাহি এসে গ্রামবাসীদের নেতৃত্ব দেওয়া সাধন চৌধুরী-সহ চারজনকে গ্রেফতার করে। এতে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। খাদ্যের অভাবে, আর্থিক অনটনে জর্জরিত এলাকার মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। পুলিশের উপর চড়াও হয়ে ধৃত চারজনকে ছিনিয়ে নেন তাঁরা। সেইসঙ্গে চারটি বন্দুক-সহ পুলিশের পোশাক খুলে তা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার রেশ গিয়ে পড়ে আনন্দপুরেও। এখানকার সাব রেজেস্ট্রি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেন জনতা। আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মেদিনীপুর থেকে বিশাল পুলিশবাহিনী সশস্ত্র অবস্থায় কেশপুরের দিকে রওনা হয়। উদ্দেশ্য জনতার আন্দোলন দমন করে ব্রিটিশ মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা। রাস্তায় কোটা নামে এক জায়গায় সশস্ত্র পুলিশকে বাধা দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশ জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কোটা গ্রামের সতীশচন্দ্র মাইতি, কুঁয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা সতীশচন্দ্র ভুঁইয়া। সেখানে পুলিশের গুলিতে গুরুতর জখম হন আরও ৫ - ৬ জন।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কেশপুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তা লবণ সত্যাগ্রহই হোক বা ভারত ছাড় আন্দোলন। মোহবনির ক্ষুদিরাম বসুর নাম তো সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত।
কৃতজ্ঞতা: অরিন্দম ভৌমিক, আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক