উন্নাওয়ের নির্যাতিতাকে লখনউ থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দিল্লি।
ধন্য উন্নাও। ধর্ষণের বিচার চাহিলে সেখানে ধর্ষিতাকে অগ্নিদগ্ধ হইতে হয়। গত বৎসর উন্নাওয়ের এক সতেরো বৎসরের কিশোরী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বাসস্থানের সামনে নিজের গায়ে অগ্নিসংযোগ করেন বিচার পাইবার আশায়। শুক্রবার অপর এক ধর্ষিতা তরুণী আদালতে যাইবার পথে অগ্নিদগ্ধ হইলেন অভিযুক্তদের হাতে। প্রাণ বাঁচাইবার আশায় প্রায় এক কিলোমিটার ছুটিতেছেন ওই তরুণী, এই ভয়ানক দৃশ্য ভাবিয়া কে স্থির থাকিতে পারে? এই কি যোগী আদিত্যনাথ আর নরেন্দ্র মোদীর ‘রামরাজ্য’? আইনশৃঙ্খলার প্রতি বলদর্পীর চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য দেখিয়া গোটা দেশ শিহরিয়া উঠিয়াছে। প্রশ্ন উঠিবে, এমন ভয়ানক ঘটনা যে বার বার উন্নাওয়ের মতো ছোট একটি জনাঞ্চলেই ঘটিতেছে, ইহা কি কাকতালীয়? বিশেষত ২০১৭ সালের জুন মাসে সতেরো বৎসরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাতে বিষয়টি সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে সমালোচিত হইয়াছে। ধর্ষণের বিচার চাহিতে গিয়া কন্যা অগ্নিদগ্ধ হইয়াছেন, তাঁহার পিতা কারারুদ্ধ অবস্থায় নিহত হইয়াছেন, তাঁহার কাকা বহু পুরাতন একটি মামলায় কারাবাস করিতেছেন। তদুপরি এই বৎসর ওই কিশোরী ও তাঁহার পরিবারের গাড়ির সহিত একটি ট্রাকের সংঘর্ষ ঘটে, যাহাতে গুরুতর আহত হন ওই কিশোরী। এই প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা লইয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে। ধর্ষণের প্রতিকার চাহিবার ‘স্পর্ধা’ দেখাইবার জন্য ধর্ষিতা ‘শিক্ষা’ দিবার যে চেষ্টা প্রভাবশালীদের মধ্যে কাজ করিতেছে, রাষ্ট্রশক্তি কি তাহাকে সত্যই প্রতিরোধ করিতে চাহে? প্রশাসনের যে অকর্মণ্যতা— তাহকে কি কেবলই ব্যর্থতা বলিয়া ধরা যায়, না কি এক প্রকার সমর্থন বলিয়া ধরাই ভাল?
ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রতি প্রশ্রয়ের আবহ না থাকিলে কী করিয়া উন্নাওতে প্রকাশ্য দিবালোকে ফের একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হইতে পারিল? ধর্ষকের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আদালতে যাইবার পথে ধর্ষিতার উপর আক্রমণ কেবল একটি অপরাধ নহে। তাহা সকল নারীর প্রতি একটি বার্তা। তাহা সম্ভবত এই যে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও ভয়ানক বিপদ ডাকিয়া আনিবে, রাষ্ট্র নির্যাতিতাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। আইনের শাসন, সংবিধান-নির্দিষ্ট মৌলিক অধিকার, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, সভ্যতার মৌলিক নীতিগুলির একেবারে কেন্দ্রে আঘাত করিতেছে পুরুষতন্ত্রের এই ঔদ্ধত্য। বিষয়টি অতএব কেবল নারীর অধিকারের নহে। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদার সহিত বাঁচিবার অধিকারের। রাষ্ট্রক্ষমতা যদি ধর্ষণের বিচারও নিশ্চিত করিতে না পারে, ধর্ষিতার প্রাণের নিরাপত্তাও না দিতে পারে, তাহা হইলে প্রশ্ন করিতেই হইবে, ওই ক্ষমতা কাহারা নিয়ন্ত্রণ করিতেছে? শ্রমিক হইবে দাস, নারী সেবাদাসী, পুরুষতান্ত্রিক-সামন্ততান্ত্রিক এই সুখস্বর্গ রচনা করিতেই কি অগণিত নরনারী স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন যুদ্ধ লড়িয়াছিলেন? কখনও বর্ণব্যবস্থায় আধিপত্যের কারণে, কখনও রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকিবার সুবাদে, সুরক্ষা মিলিতেছে ধর্ষকদের, আর বিপন্ন হইতেছেন ধর্ষিত, নির্যাতিত মেয়েরা।
এই চিত্র নূতন নহে। পশ্চিমবঙ্গ ভোলে নাই মধ্যমগ্রামের সেই কিশোরীর কথা, ধর্ষণের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ লিখাইবার জন্য যাঁহাকে পুনরায় গণধর্ষণ করা হইয়াছিল, এবং আদালতে সাক্ষ্য দিবার পূর্বেই ধর্ষণে অভিযুক্তরা তাঁহার বাড়িতে ঢুকিয়া তাঁহাকে অগ্নিদগ্ধ করিয়া মারিয়াছিল। তাহা ছিল ২০১৪ সাল। গত পাঁচ বৎসরে কত কিশোরী-তরুণী আইন-অরক্ষিত হইয়া বিচার চাহিয়াছেন, তাঁহাদের কত জন ‘দুর্ঘটনায়’ মরিয়াছেন, কত জন কত হুমকি সহিতেছেন, কে বলিতে পারে? তবু কত সহস্র মেয়ে বিচারের আশা ছাড়েন নাই। ভরসা যদি কিছু থাকে, তবে এই মেয়েদের ন্যায়ের প্রত্যাশাটুকুই।