একজোট হওয়া মানুষ পাহাড় সরাতে পারে, তাই এত ভয়

সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, নাগরিকত্বের জন্য কোনও মানুষের জাত, ধর্ম, লিঙ্গের বাছবিচার করা যাবে না। তা-ও কেন অমিত শাহ এ কথা বললেন? লিখলেন সুমন সেনগুপ্তকিন্তু তাড়িয়ে দেব বললেই তো আর সেটা করা যায় না, তাই তাঁদের এই চাল। তাঁরা প্রতিপন্ন করতে চাইবেন যে, তাঁরা মুসলমান বাদে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের রক্ষাকর্তা এবং তাই তাঁরা মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়াকে আটকাবে। কিন্তু আমরা যাঁরা সংবিধানকে মান্যতা দিই, তাঁরা প্রশ্ন করবেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৯ ০৫:২৪
Share:

প্রতীকী চিত্র। (ছবি: শাটারস্টক)

ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে, বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভাল করে...।’’— এই গানের সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মিল খুঁজলে কোনও পুরস্কার নেই। পুজোর মুখে মুখেই কলকাতায় এসেছিলেন বিজেপির সভাপতি এবং দেশের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ। কলকাতায় এসে তিনি হুঙ্কার ছেড়েছেন, প্রতিবেশী দেশ মানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে যদি কোনও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ মানুষ এ দেশে আসেন, তা হলে তাঁদেরকে ‘শরণার্থী’ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাঁদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। যেটা উহ্য রেখেছেন তা হল— এ দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ, মানে মুসলমানদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।

Advertisement

কিন্তু তাড়িয়ে দেব বললেই তো আর সেটা করা যায় না, তাই তাঁদের এই চাল। তাঁরা প্রতিপন্ন করতে চাইবেন যে, তাঁরা মুসলমান বাদে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের রক্ষাকর্তা এবং তাই তাঁরা মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়াকে আটকাবে। কিন্তু আমরা যাঁরা সংবিধানকে মান্যতা দিই, তাঁরা প্রশ্ন করবেই। তাঁরা কিন্তু এটা জানেন যে, ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ বনাম কেরালা সরকারের যে মামলা দেশের সর্বোচ্চ আদালতে হয়েছিল সেই মামলার রায়ে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল— সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বদলের ক্ষমতা সংসদের বা পার্লামেন্টের নেই। সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারা তাই বলে। এ ছাড়াও সংবিধানের ১৪ নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে যে, নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য কোনও মানুষের জাত, ধর্ম, লিঙ্গের বাছবিচার করা যাবে না।

কিন্তু তা-ও কেন অমিত শাহ এটা বললেন? এর একটাই সম্ভাব্য কারণ, ভয় দেখানো। শুধু ভয় দেখাতে পারলেই হবে, তা হলে আর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। এই যে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, এই যে মানুষের কাজ চলে যাচ্ছে, বিভিন্ন ছোটখাট ব্যবসা বন্ধ হয়ে তার কর্মীরা ক্রমশ কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, সেই মানুষেরা যদি একজোট হতে শুরু করেন তা হলেই তো সর্বনাশ! একজোট হওয়া মানুষ তো পাহাড় সরাতে পারে, তাই তাঁদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্যই শাসকদলের এই আস্ফালন। মানুষ যদি হিন্দু-মুসলমান প্রভেদ মুছে উঠে দাঁড়ায়, তা হলে তো সমূহ বিপদ। তাই সারা দেশে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে দাও— প্রত্যেককে ব্যস্ত রাখ এই আধার, ডিজিটাল রেশন কার্ড, নাগরিকপঞ্জী কিংবা সংশোধনী বিল এ সব দিয়ে। যাতে মানুষ ভাবার অবকাশও না পায়।

Advertisement

তাই সারা দেশ এই মুহূর্তে এনআরসি-জ্বরে কাঁপছে। যেখানেই যাওয়া যাক না কেন, সেখানেই প্রতিটি মানুষ কী করে তাঁর নিজের কিংবা পরিবারের কাগজপত্র ঠিক করা যায়, সেই প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। যেখানেই কথা বলা যাচ্ছে সেখানেই এক আলোচনা। তা সে পাড়ার চায়ের দোকান বা অফিস কাছারি, কল কারখানা— সর্বত্র এক আলোচনা। এই আলোচনায় কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করা যাচ্ছে— সবাই খুব ভীত, সন্ত্রস্ত। সবাই নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। সেই এক কথা ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম।’ তা হলে কি মানুষ খুব স্বার্থপর? সেই স্বার্থপর ভিতরের মানুষটিকেই টেনে বের করে এনেছে এই আজকের শাসক? অসমে এর মধ্যে ১৯ লক্ষ মানুষ দেশহীন হয়েছে। কাশ্মীরে একটা রাজ্যের পুরো জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। তাঁরা কি আদৌ কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে আসবেন ঘর বাড়ি বিক্রি করে, না কি তিলে তিলে মারা যাবেন

— সেটা আগামী দিন বলবে। কিন্তু আপাতত সারা দেশে না হলেও বাংলার মানুষ বড় ভীতসন্ত্রস্ত।
এখনও অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী প্রায় ২০ জন মানুষ মারা গিয়েছেন ট্রমায়। কারও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, কেউ বা আত্মহত্যা করেছেন। যদি খেয়াল করা যায়, নোটবন্দির সময়েও একই ভাবে প্রচুর মানুষ নোটবদলের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কি কিছু এসে গিয়েছে আমাদের? আমরা খবর পেয়েছি ঝাড়খণ্ডের ১১ বছরের সন্তোষী, তাঁর মায়ের কাছে ভাত-ভাত করতে করতে মারা গিয়েছিল। তার মা তাকে ভাত দিতে পারেননি। কারণ, তাঁর মায়ের রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার যুক্ত ছিল না। এই সমস্ত খবর পড়ে কিংবা পেয়েও সাধারণ মানুষ ভোর না হতেই ডিজিটাল রেশন কার্ড বানানোর জন্য, আধারের সঙ্গে রেশন কার্ড সংযোগ করানোর জন্য লাইন দিচ্ছেন। কারওর মনে একবারও প্রশ্ন আসছে না যে, কাশ্মীরের এতগুলো মানুষ তো তিন মাস হয়ে গেল সমস্ত যোগাযোগ বিহীন হয়ে, প্রায় না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কী করে পারছেন? একবারও প্রশ্ন আসছে না অসমের ১৯ লক্ষ মানুষ কী করবেন? শুধু তো মুসলমান নয়, প্রায় ১২ লক্ষ হিন্দুও আছেন ওই ‘না মানুষের’ তালিকায়। দেশহীন মানুষ তো ‘না মানুষের’ তালিকাতেই পড়ে, তাই না?

বহু দিন আগে শোনা একটা গানের কথা— ‘মানুষ বড় ভয় পেয়েছে, মানুষ বড় কাঁদছে হায়’। কিন্তু এই মানুষদের কথা কি ভাবছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলেরা? যদি ভাবত, তা হলে এঁদের উপরে যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়েও ভাবত। উপর উপর কথা বললে এর কোনও সুরাহা কী হবে, প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছনো কি জরুরি নয়? বিভিন্ন জায়গায় এই বিষয়ে সভা করতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়তো অনেকেই হচ্ছেন। তর্কের খাতিরে ধরেও যদি নেওয়া যায়, বাংলায় কিংবা দেশের অন্য রাজ্যে নাগরিকপঞ্জী হবে না, রাষ্ট্র কোনও তালিকা বানাবে না, তা হলেও মানুষেরা ভাবছেন যে, নিজের নিজের কাগজপত্রকে সঠিক করে নেওয়াটা নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু সত্যি কি এটা এক জন নাগরিকের কর্তব্য? না কি এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের অধিকারকে সুনিশ্চিত করা? কেন এক জন নাগরিককে প্রমাণ করতে হবে সে এই দেশের বৈধ নাগরিক? কেন কোনও নাগরিক চিৎকার করে বলছেন না— ‘আমি এই দেশের নাগরিক, দেখি তুমি আমায় প্রমাণ করো আমি নাগরিক নয়’! এই চিন্তাটাই যদি জারিত করা যায় প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে তবেই একমাত্র আসামের ১৯ লক্ষ কিংবা কাশ্মীরের ৭০ লক্ষ মানুষের অসুবিধা বোঝা যাবে। না হলে সরকারি প্রচারের ঢক্কানিনাদের নীচে চাপা পড়ে যাবে দুই রাজ্যের বঞ্চিত মানুষদের কান্না।

কিন্তু এত কিছুর পরেও আমাদের মধ্যে এই নির্লিপ্ততা কেন? আমরা কেন সমস্ত কিছু দেখেও চুপ করে ‘ভাল মানুষ’ হয়ে বসে আছি? আমি ব্যক্তিগত ভাবে কিন্তু সমষ্টিকে দোষ দেব না। অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, কী হবে কথা বলে? শেষমেশ তো একটা গুলি আর খবরের কাগজে একটা ছোট খবর। খুব বেশি হলে ৫ দিন। কী হবে ইউএপিএ, আরটিআই বা কাশ্মীর বা অসমের ১৯ লক্ষ মানুষ নিয়ে কথা বলে? আদৌ কি যাঁদের উদ্দেশে বলা তাঁদের কানে পৌঁছবে?

আসলে আমরা নিজেদের নিয়ে কিছু মাপকাঠি তৈরি করেছি। আমরা পরিবেশ নিয়ে কথা বলেছি কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবির বিরুদ্ধে কথা বলব না ঠিক করেছি। আমরা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি কিন্তু তাঁদেরকে একটা ঘর দিতে পারিনি। আমরা ঘৃণা-বিদ্বেষ নিয়ে কথা বলেছি, অথচ, ঘরের মানুষ বা কাছের মানুষের কাছ থেকে যখন হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পেয়েছি, তখন সেটার বিরোধিতা করিনি। চোখের সামনে দেখেছি যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি এক এক করে দখল হয়ে গিয়েছে, তবুও মুখ খুলিনি।

আমি ঘৃণাকে বাড়তে দিয়েছি কারণ আমি সেটাকে কমানোর জন্য যা করার প্রয়োজন, সেটা আমি করিনি। এই আমি আমাদের চারপাশের মধ্যে আত্মগোপন করে আছে। হয়তো এই লেখাটা পড়তে পড়তে অনেকের মনে হবে— ‘কে এই মানুষটা, এত কথা বলছে!’
আসলে আবারও হয়তো আপনি আসল জায়গা থেকে সরে গিয়ে আমার দিকে আঙুল তুলছেন। আপনার ভিতরের কোনও এক জন মানুষ হয়তো অনেক কিছু বলতে চাইছে। হয়তো সে বলতে চাইছে যে, কই কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা যখন অত্যাচারিত হয়েছিল, তখন তো আপনি কিছু বলেননি? হয়তো সে বলতে চাইছে, কোনও হিন্দু মহিলা যদি মুসলমান মানুষ দ্বারা ধর্ষিতা হন কই তখন কেন কিছু বলেননি?
কিন্তু বলিনি মানে কি এখনকার সমস্ত কিছুকে মান্যতা দিতে হবে? বলিনি মানে কি তবরেজ আনসারিকে বা পেহলু খানকে পিটিয়ে মারাকে সমর্থন করতে হবে? না কি আমরা তখন নির্লিপ্ত ছিলাম বলে আজও আমাদের নির্লিপ্তই থাকতে হবে? এই নির্লিপ্ত থাকতে থাকতে না এক দিন নির্লিপ্ত থাকার মতো মানুষেরও খোঁজ পাওয়া যাবে তো?

‘‘ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে/ বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভাল করে...’’ এই গান শুনতে শুনতে হয়তো আবারও ভুলে যাব চারপাশের না মানুষদের কথা!

লেখক : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement